ডলারের দাম সাত মাসে সর্বনিম্ন, দেশেও কমার আশা
ডলারের তেজ কিছুটা কমেছে। সোমবার বিশ্ববাজারে ডলারের দাম কমে সাত মাসে সর্বনিম্ন হয়েছে। এশিয়ার বাজারে এর বেশ প্রভাব পড়েছে। এদিন প্রতিদ্বন্দ্বী মুদ্রাগুলোর বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম কমে হয়েছে ১০১.৭৭ ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বাড়ানোর জেরে ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তা এখন কমতে শুরু করেছে।
রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ রেমিট্যান্স বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া নানা পদক্ষেপে দেশেও শিগগিরই ডলারের সংকট কাটবে বলে আশা করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিশ্ববাজার : মার্কেট ইনসাইডারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে বিশ্ববাজারে ডলারের দাম ১৭ শতাংশের বেশি বাড়লেও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর শেষ তিন মাসে দাম পড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। এই দরপতন এ বছরও অব্যাহত থাকবে।
ইউবিএস গ্লোবাল ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের এশিয়া প্যাসিফিক পণ্য ও বৈদেশিক মুদ্রাবিষয়ক প্রধান ডমিনিক সিনিডার বলেন, ‘২০২৩ সালে আমরা ডলারের আরো পতন দেখতে পাব। কারণ ফেডারেল রিজার্ভ মুদ্রানীতি আর কঠোর করবে না, বরং কিছুটা শিথিল করতে পারে।’
সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মুদ্রাবাজারে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের দাম কমছেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান মুদ্রা ইউরোর বিপরীতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে ডলারের মূল্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি কমছে। এতে স্পষ্ট যে ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) সুদের হার কমাতে পারে। কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ থেকে সরে আসবে তারা। এতে ডলারের দরপতন ঘটছে।
গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) কমেছে ০.১ শতাংশ। এ নিয়ে ২০২০ সালের মে মাসের পর প্রথমবারের মতো তা কমল। সিপিআই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইউরোর বিপরীতে ডলারের দর নিম্নমুখী হয়েছে প্রায় ১ শতাংশ। প্রতি ইউরোর মূল্য স্থির হয়েছে ১.০৮৪৫ ডলারে। গত ২১ এপ্রিলের পর যা সর্বনিম্ন।
ব্রিটিশ পাউন্ডের বিপরীতে ডলারের দাম হ্রাস পেয়েছে ০. ৫৬ শতাংশ। পাউন্ডপ্রতি মূল্য নিষ্পত্তি হয়েছে ১.২২১৯৫ ডলারে। জাপানি ইয়েনের বিপরীতে ২.৭ শতাংশ শক্তি হারিয়েছে ডলার। এক ডলার বিক্রি হয়েছে ১২৯.৩৫ ইয়েনে। চীনের অফশোরে ইউয়ানের বিপরীতে ডলারের মূল্যমানও কমেছে। প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৬.৭৩৩১ ইউয়ানে।
দেশের বাজার : দেশে আন্ত ব্যাংক মুদ্রাবাজারে জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন ১০৩ থেকে ১০৭ টাকায় ডলার বিক্রি হচ্ছে। খোলাবাজারেও ডলারের দাম কিছুটা কমেছে। মতিঝিল ও পল্টনের মানি এক্সচেঞ্জে সোমবার খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা সপ্তাহ দুয়েক আগেও ছিল ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা।
গত সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ডলারের সর্বোচ্চ রেকর্ড বিক্রয়মূল্য ছিল ১২০ টাকা পর্যন্ত। এ সময় ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বিভিন্ন ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ পরিদর্শন শুরু করে। তখন অবৈধভাবে ডলার ব্যবসার অভিযোগে ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর সনদ না থাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করেছে।
গত নভেম্বরে দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আশা প্রকাশ করে বলেন, ডলারের সংকট জানুয়ারিতে শেষ হয়ে যাবে। মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় তিনি বলেন, ‘আমি যোগ দেওয়ার পর আমদানি কমাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। বেশি দামে ঋণপত্র যেন খোলা না হয়, এ জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। এসব পদক্ষেপের ফলে আমদানি কমেছে। এখন প্রতি মাসে আমদানিতে যে খরচ হচ্ছে, রপ্তানি ও প্রবাস আয় তার চেয়ে বেশি। তবে আগের আমদানি দায় এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ জন্য ডলারের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।’
দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদের কথা জানিয়ে গভর্নর বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি, এর চেয়ে আর খারাপ হবে না। আমাদের অর্থনীতির যে সহনশীলতা, সেটি অত্যন্ত গভীর। যেকোনো একটি ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতি পড়ে যাবে না। আমাদের দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে। আশা করি, ভালো দিন শিগগিরই আসবে।’
রেকর্ড রপ্তানি আয়ে ডলার সংকট কাটার আশা : বছরের শুরুতে সুসংবাদ দিল দেশের তৈরি পোশাক খাত। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে দেশের রপ্তানি আয়ে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি। এতে ডলারের সংকটও কেটে যাবে বলে আশা রপ্তানিকারকদের।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে রেকর্ড পরিমাণ ৫৩৬ কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা এক মাসের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরেও ৪৯০ কোটি ৭৬ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। এ বছর নভেম্বরে প্রথমবারের মতো এক মাসের রপ্তানি আয় ৫০০ কোটির ঘর ছাড়ায়। এই হিসাবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৯.৩৩ শতাংশ বেড়েছে। ডিসেম্বরে ৫৪২ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল সরকার। তাতে রপ্তানির অর্জন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১.০৩ শতাংশ পিছিয়ে থাকল।
রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ছে : নতুন বছরের শুরুতে প্রবাস আয়ে ইতিবাচক ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে। চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম ১৩ দিনে ৯২ কোটি ৮৬ লাখ (৯২৮ মিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচ্য সময়ে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৭৭ কোটি ১৩ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১২ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলার, বিশেষায়িত এক ব্যাংকের মাধ্যমে দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৩১ লাখ মার্কিন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সদ্যঃসমাপ্ত ডিসেম্বর মাসে ১৬৯ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৮ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এই অঙ্ক ২০২১ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে প্রায় সাত কোটি ডলার বেশি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৩ কোটি ডলার।
বিদায়ি ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার।
রিজার্ভ ৩২.৫১ বিলিয়ন ডলার : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিলেও প্রতি ডলারের বিক্রয়মূল্য ছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। এখন তা প্রায় ১৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকার ওপরে। দেশে ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া আমদানি দায় মেটাতেও কমছে রিজার্ভ। ডলার সংকটের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের রিজার্ভ ৩২.৫১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হয়, তাহলে রিজার্ভ আরো ৮.৪০ বিলিয়ন ডলার কম হবে। সেই হিসাবে এখন প্রকৃত রিজার্ভ ২৪.১১ বিলিয়ন ডলার।