কাল মিরপুরে অলক্ষ্যে যেন সেই বজ্র কণ্ঠও শোনা গেল, ২০১৫-র অ্যাডিলেইড ওভালে যা গোটা বিশ্বকে শুনিয়েছিলেন নাসের হুসেইন। সেবার ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করতে না করতেই কমেন্ট্রি বক্সে মাইক্রোফোন হাতে এভাবেই গর্জে উঠেছিলেন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক, ‘বাংলাদেশ টাইগার্স হ্যাভ নকড দ্য ইংল্যান্ড লায়নস আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ। ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট ডে’জ ইন বাংলাদেশ ক্রিকেট হিস্ট্রি, ওয়ান অব দ্য লোয়েস্ট পয়েন্ট ইন ইংলিশ হিস্ট্রি।’
তুলনায় গেলে আট বছর আগে-পরে বাংলাদেশের সামনে ইংল্যান্ডের একই নিয়তির মধ্যে কোনটিকে ছেড়ে কোনটি এগিয়ে থাকে, তা নিয়ে দ্বিধার অবসানও বোধ হয় করে দিল গত সন্ধ্যার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে হারা ইংলিশদের তখনো সাদা বলের ক্রিকেট শ্রেষ্ঠত্বের পথে উত্তরণই শুরু হয়নি। আর এবার বাংলাদেশ সফরে আসার সময় তাদের গায়েই লেপ্টে ছিল ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টির বিশ্বচ্যাম্পিয়নের সোনালি রং। মাত্র চার মাস আগে অস্ট্রেলিয়ায় কুড়ি-বিশের বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরা সেই ‘ইংল্যান্ড লায়নস’ই কিনা এবার বাঘের হুঙ্কারে অসহায় আত্মসমর্পণের করুণ ছবি ফুটিয়ে তুলল। ১৬ রানের হারে বাংলার মাটিতে হলো হোয়াইটওয়াশ। এর আগে জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এই সংস্করণে হোয়াইটওয়াশ করা বাংলাদেশ এই প্রথমবার বড় শিকারকে টেনে নামাল মাটিতে।
অথচ টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর মিশনে নামা জস বাটলারের দিকে ভাগ্য মুখ তুলে তাকিয়েছিল কালই প্রথম। এই সফরে কেবলই টস হারতে থাকা ইংলিশ অধিনায়ক শেষ ম্যাচে এসে জিতলেন এবং বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়েও পাঠালেন। এই সিরিজের স্বাগতিকরা এমন ক্রিকেট খেলেছে যে ২০ ওভারে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে ১৫৮ রান জমা করা নিয়েও ফিসফিস শুরু হয়ে গিয়েছিল। শেষ ৫ ওভারে মাত্র ২৭ রান উঠল, তাতে উইকেটের দায়ও দেখলেন কেউ কেউ। কিন্তু ১৭তম ওভারের শেষ বলে আউট হওয়ার আগে লিটন কুমার দাস ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলার পরও সেটিকে এই যুগের টি-টোয়েন্টিসুলভ ইনিংস বলে ধরা হচ্ছিল না।
ম্যাচ শেষে তাই ‘১৫-২০ রান কম হয়েছে’ বলে শোনার প্রস্তুতিও চলছিল। কেন চলবে না? ইনিংসের তৃতীয় বলেই অভিষিক্ত বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম আনন্দের উপলক্ষ এনে দেওয়ার পর তো আর কোনো খুশির ঝিলিকই দেখা যাচ্ছিল না। ফিল সল্ট বিদায় নেওয়ার পর যে আর উইকেট পড়ে না। বরং বাটলারের সঙ্গে ৯৫ রানের জুটিতে ডেভিড মালান দলকে ১৩ ওভারে ১০০ রানে নিয়ে যাওয়ার পর ইংলিশদের জয় যেন কেবলই সময়ের ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। সেখান থেকেই ২ বলের মধ্যে ভোজবাজির মতো বদলে গেল পরিস্থিতি। মুস্তাফিজুর রহমান ১৪তম ওভারের প্রথম বলে ততক্ষণে ফিফটি করে ফেলা মালানকে (৪৭ বলে ৫৩) বানান নিজের শততম টি-টোয়েন্টি শিকার। পরের বলেই গ্যালারির গর্জনে কান পাতা দায় হয়ে গেল, বাঁধভাঙা জোয়ার বইয়ে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। আগের ম্যাচেই অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সিরিজ জয়ের নায়ক এবার বোলার হিসেবে নয়, ম্যাচ ভাগ্য গড়ে দেওয়া মুহূর্তের জন্ম দিলেন ফিল্ডার মিরাজ!
নতুন ব্যাটার বেন ডাকেট বল ঠেলেই ছুটেছিলেন, বাটলারও সাড়া দেন। কিন্তু নন স্ট্রাইকার প্রান্ত থেকে দৌড়ে পৌঁছানোর আগেই হতভম্ব হয়ে যান ইংলিশ অধিনায়ক। পয়েন্ট থেকে মিরাজের সরাসরি থ্রোতে বাটলার (৩১ বলে ৪০) রান আউট হতেই সে কী এক দিগ্বিদিক দৌড় মিরাজের! পয়েন্ট থেকে দৌড়ে উল্লাস করতে করতে ছুটে আসেন লংঅফ সীমানার দিকে। ম্যাচের লাগামও তখনই অনেকটা ছুটে গেল ইংল্যান্ডের হাত থেকে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বিজয়ও যেন লেখা হয়ে গেল। উজ্জীবিত বাংলাদেশ আরো চেপে ধরল সফরকারীদের।
তাসকিন আহমেদ ভাঙলেন ডাকেটের অফস্টাম্প। এর আগে মঈন আলীকেও বানান মিরাজের ক্যাচ। ব্যস, ইংলিশরা আর ঘুরেই দাঁড়াতে পারে না। উইকেট মাত্র একটি পেলেও মুস্তাফিজ নাভিশ্বাস তুলে ছাড়েন আরেকবার। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ২৪ বলের মধ্যে ১৫টিই ডট করেছিলেন এই বাঁহাতি পেসার। কাল করলেন ১৪টি! ৪ ওভারে ১৪ রান দিয়ে ধরা একমাত্র শিকারের বোলিং ফিগার তাঁর বোলিং মহিমার পুরোটা প্রকাশও করতে পারছে না। শেষ ২ ওভারে ইংল্যান্ডের জন্য তাই ৩১ রানের সমীকরণ দাঁড়ায়। সাকিব আল হাসান ১৯তম ওভারে মাত্র ৪ রান দিয়ে স্যাম কারানকে তুলে নেওয়ার পর যা দুঃসাধ্যই হয়ে পড়ে। ৬ বলে ২৭ রান! তাই লিটনের ৭৩ রানের ইনিংসই হয়ে ওঠে ম্যাচসেরা হওয়ার পক্ষে আদর্শ। আগের দুই ম্যাচে ৫১ ও অপরাজিত ৪৬ রানের পর এবার যখন আবার হার না মানা ৩৬ বলে ৪৭, তখন ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশের মঞ্চে নাজমুল হোসেন শান্তর সিরিজসেরা হওয়াও ছিল তর্কাতীত।
সব মিলিয়ে যা হলো, তাতে নাসের হুসেইন গর্জে উঠলেই সবচেয়ে বেশি মানাত।