জিরো থেকে হিরোর গল্প
১৮৮৯ সাল, দক্ষিণ লন্ডনের এক ছোট্ট ঘরে জন্ম হয় স্যার চার্লেস স্পেন্সার চার্লি চ্যাপলিনের। যদিও এটা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। বাবা-মা দু’জনই অন্যদের আনন্দের খোরাক হিসেবে কাজ করতেন তখন, অর্থাৎ তারা দু’জনেই মিউজিক হলে গান গাইতেন। কিন্তু তারা তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। চার্লির মা ছিলেন এক মুচি পরিবারের সন্তান।
চার্লি ছিলেন তার মায়ের দ্বিতীয় ঘরের সন্তান। যেহেতু বাবা-মা দু’জনই বিনোদন জগতে কাজ করতেন সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই চার্লির ভেতরও শৈল্পিক দিকগুলো কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। কিন্তু পরিবারের আয় যৎসামান্য ছিল। তার ওপর বাবা-মা আলাদা থাকতেন।
অভাবের তাড়নায় মাত্র সাত বছর বয়সে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন চার্লি। কিন্তু জীবনে বিপর্যয় আরও বাকি ছিল। চার্লির বয়স যখন নয় বছর তখন তার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। চার্লি এবং তার সৎভাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চার্লির বাবার কাছে। চার্লির বাবা ছিলেন বিভিন্ন নেশা জাতীয় জিনিসে আসক্ত। ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা তিনি কোনোভাবেই করতে পারতেন না।
দিনের পর দিন দুই ভাই একা ঘরে খাবার-দাবার ছাড়া আটকা পড়ে থাকতেন। কখনও খাবারের খোঁজে পথে পথে ঘুরতেন, পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকতেন। কখনও কখনও অন্য পথশিশুদের সঙ্গে মনোমালিন্য হতো, হতো হাতাহাতি। তাই সরকারিভাবে বাচ্চাদের দেখভালের জন্য সরকারি শিশু সদনে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। এবং ঠিক তার দুই বছর পর, চার্লির বাবা মারা যান। সম্পূর্ণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন দু’ভাই।
বড় ভাই নৌবাহিনীতে যোগ দিতে চলে গেলে আরও একা হয়ে পড়েন চার্লি। ভবঘুরের মতো পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন। বিভিন্ন বোহেমিয়ান দলের সঙ্গে চলাফেরা বাড়তে থাকে।
বাবার মৃত্যুর এক বছর পর যোগ দেন ‘এইট ল্যাংকাশায়ার লেড’ দলে। দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে করতে শুরু করেন গান, নাচ। এরপর যুক্ত হয়ে পড়েন কমেডিয়ান দলের সঙ্গে। পাশাপাশি করতেন মূকাভিনয়।
১৯১৩ সাল, নিউইয়র্ক মোশন পিকচার কোম্পানি সাপ্তাহিক ১৫০ ডলারের ভিত্তিতে চার্লির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। বলা যেতে পারে ভাগ্যের লিখন, এরপরের বছর বেশ ক’টি ছবি মুক্তি পায় চার্লির। রাতারাতি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। পেছনের দুঃখের সময়গুলো ম্লান হতে শুরু করে।
১৯১৫ সালে চার্লি স্বয়ং পরিচালনা, চিত্রনাট্য এবং গল্প লেখার কাজও শুরু করেন। ১৯১৮ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে নয়টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ফেলেন তিনি। এবং সেগুলোর বেশিরভাগই দর্শকজনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯২৫ সালে নিজের প্রযোজিত ছবির জন্য পান একাডেমি অ্যাওয়ার্ড। ১৯৩৬ সালে মুক্তি পায় অন্যতম সাড়া জাগানো ছবি ‘মডার্ন টাইমস’।
ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের কারণে বিশ্বের পরিবর্তন সম্পূর্ণ নির্বাক ছবিতে শুধু অভিব্যক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ১৯৫২ সালে মুক্তি পায় লাইম লাইট নামে আত্মজীবনীমূলক ছবি। এটিও দর্শকদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। কিন্তু এত শত খ্যাতির পরও পারিবারিক জীবনে তিনি উলেল্গখ করার মতো সুখী ছিলেন না।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চারবার সংসার জীবনে পা রাখলেও শুধু শেষ পরিণয়টিই শেষ পর্যন্ত তার অন্তিম মুহূর্তে পাশে ছিল। ১৯৭৭ সালে, সদা হাস্যোজ্জ্বল এই প্রিয় মানুষটি চলে যান না ফেরার দেশে। একাধারে অভিনেতা, গায়ক, চিত্রনাট্যকার, গল্প লেখক, পরিচালকসহ আরও বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত এই মানুষটি একটি দুর্বিষহ শৈশব পার করে এলেও জীবনের কাছে কখনও হার মানেননি।
এজন্যই হয়তো তিনি পেয়েছেন সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন সম্মানজনক পদকে। অনেক বেশি জীবনমুখী ছিলেন বলেই হয়তো আজও তাকে আমরা স্মরণ করি। অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিলেন বলেই হয়তো এই মহৎপ্রাণ বলে গিয়েছেন, ‘আমার জীবনে অনেক সমস্যা আছে কিন্তু আমার ঠোঁট তা জানে না, তাই সে সবসময় হাসতে থাকে।’