চলে গেলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, তার জীবনী
জাতির ক্রান্তিকালে সোচ্চার ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। সব সময় উচিত কথা বলতেন, কখনো কারো রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি। আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের পক্ষেও আইনি লড়াই করেছেন তিনি। আবার তাঁদের অপকর্মের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।
শুধু বাংলাদেশেরই নয়, ভারত, পাকিস্তান ও ব্রিটেনের নাগরিক হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুড়িতে। বিশাল অভিজ্ঞতা, বিশাল খ্যাতির শিখরে অবস্থান করা এই প্রবীণ আইনজীবীর জীবনের অন্তরালে ছড়িয়ে আছে অনেক কৃতিত্ব। তিনি এক অনন্য সমাজসেবী। অন্য রকম এক মানুষ। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করলেও পেশাগত জীবনে তিনি কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হননি। কিন্তু রাজনীতিবিদরা সবাই তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছেন। জাতীয় নেতাদের কাছে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, এইচএম এরশাদ- সবার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন প্রবীণ এই আইনজীবী। কিন্তু কখনো কোনো পারিশ্রমিক নেননি। এরশাদ সরকারের আমলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। কিন্তু কোনো সম্মানী নেননি। প্রতীকী সম্মানী এক টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এক টাকা তুলতে দুই টাকার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে, সে কারণে তাও নেননি।
নিজের স্বাধীনতাকে জিম্মি করে কাজ করেননি কখনো। রফিক-উল হক সব সময় বলতেন, ‘জীবনে যখন যেটাকে ঠিক মনে করেছি, ভালো মনে করেছি, তা-ই করেছি। নিজের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে কাজ করিনি কখনো।’
আইনের এই বাতিঘরের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে। বাবা মুমিন-উল হক পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। আর মা নূরজাহান বেগম। তবে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে কলকাতার চেতলায়। পরিবারের সবাই চেতলাতেই থাকতেন। পড়াশোনা করেছেন চেতলা স্কুলে। চেতলা এখন কলকাতার অন্তর্ভুক্ত। চেতলা স্কুলে রফিক-উল হকের পরিবারের সবাই পড়াশোনা করতেন।
ব্যারিস্টার রফিক হক ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া করেছেন। বঙ্গবন্ধুও পড়েছেন ইসলামিয়া কলেজে। তাঁরা দু’জনই বেকার হোস্টেলে থেকেছেন। কলকাতায় পড়ার সময় তাঁর বন্ধু ছিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
রফিক-উল হক ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৫১ সালে। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন। তিনি ১৯৬১ সালে ব্যারিস্টার (বার-এট-ল) ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে লিংকনস ইন-এ ডাক পান।
এরপর আইনজীবী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে তৎকালীন পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৬৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফৌজদারি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।
ওই বিষয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন। এরপর বার-অ্যাট-ল করতে গিয়েও তিনি ব্রিটেনে সাড়া জাগিয়ে ফেলেন। খুব ভালো ফল করে তাঁক লাগিয়ে দেন সবাইকে। হিন্দু আইন নিয়ে বার-অ্যাট-ল করেছেন। সেখানেও প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর তিনি জাতীয়তা পরিবর্তন করেন।
তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন শুনলেন রফিক-উল হক ব্যারিস্টারিতে হিন্দু ল-তে ফার্স্ট হয়েছেন, তখন তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে নিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু আইন পাঠ্য হয় তখনই। রফিক-উল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পরীক্ষক (একজামিনার) ছিলেন। তাঁর সময় ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক হোসেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, রেহমান সোবহানের স্ত্রী সালমা সোবহান ছিলেন। ড. এম জহির পরে আসেন। সবাই খুব নামকরা ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কাজ করে খুব তৃপ্তিতে থাকতেন ব্যারিস্টার রফিক।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের চিকিৎসক স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ২০১১ সালে। পারিবারিক জীবনে তাঁদের একমাত্র ছেলে ব্যারিস্টার ফাহিমুল হক। তিনিও বাবার সঙ্গে আইন পেশায় জড়িত।
রফিক-উল হক ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। স্টমাক ক্যান্সার হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে অপারেশনের মাধ্যমে স্টমাকটি অপসারণ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে তাঁর বাঁ পাঁজরের তিনটি হাড়ও অপসারণ করতে হয়েছে। তারপরও তাঁর মধ্যে উচ্ছলতার কমতি ছিল না। অবসরে বই পড়তেন, আর ক্রিকেট খেলা দেখার প্রতি তাঁর বেশ দুর্বলতা ছিল।
জীবনের উপার্জিত অর্থের সবই ব্যয় করেছেন সমাজসেবায়। যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মানবতার সেবায়। জীবনের বড় ইচ্ছাই মানুষের সেবা করা; সেই লক্ষ্য থেকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিক্যাল কলেজ।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করছেন। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন সুবর্ণ ক্লিনিক; ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখেন। বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নূরজাহান ওয়ার্ড, আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের চেয়ারম্যান, আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ছিলেন রফিক-উল হক।
আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদানসহ নানা সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। ঢাকায় তাঁর নিজের সম্পদ বলতে একটি বাড়ি আর দু-তিন কাঠার একটি প্লট।
জীবদ্দশায় ব্যারিস্টার রফিক বলতেন, ‘আমি আমার উত্তরসূরিদের জন্য একটি টাকাও ব্যাংকে রেখে যেতে চাই না। মানবতার সেবায় সব কিছু ইনভেস্ট করে চেতে চাই।’
দেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য ব্যারিস্টার রফিক সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের দাবি তুলেছেন অনেকবার। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে তিনি সব সময় উচ্চকণ্ঠে দাবি তুলেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায় ফাঁস হওয়ার ঘটনায়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কারো রক্ষচক্ষুকে ভয় পেতেন না। সরাসরি সমালোচনা করতে পছন্দ করতেন। যা ন্যায়, যা সত্য, তার পক্ষেই সব সময় থেকেছেন। এ কারণে রাজনীতি বা আদালতের যেকোনো ঘটনা সম্পর্কে তিনি আইন ও ন্যায়সংগত কথা বলতে পছন্দ করেছেন। এতে যে যা-ই মনে করুক, তিনি তাঁর মতামত প্রকাশে দ্বিধা করেন না। সব সময় সত্য কথা বলতেন আর আইনজীবীদেরকে সত্য বলার সাহসও জোগাতেন।
তিনি গণতন্ত্র রক্ষায় রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্রের চর্চা করতে পরামর্শ দিতেন। ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই এ দুজনের পক্ষেই আইনি লড়াই করেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।