গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ পাওয়া যাবে করোনার টিকা!
বৃটেনের বাণিজ্য মন্ত্রী অলোক শর্মা বলেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল ভালোভাবেই আগাচ্ছে। আর এই পরীক্ষা যদি সফল হয়, তাহলে এই গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ এই ভ্যাকসিনের ডোজ বিতরণের জন্য প্রস্তুত করা যাবে। অক্সফোর্ড ও ইম্পেরিয়াল কলেজে চলমান গবেষণার জন্য তিনি ৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারের নতুন অর্থায়নেরও ঘোষণা দিয়েছেন।
সারা বৃটেন তো বটেই, পুরো বিশ্বেরই নজর এখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আড্রিয়ান হিল ও তার গবেষক দলের ওপর। গত মাসে ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট অ্যাস্ট্রাজেনেকা বৃটিশ সরকারের সঙ্গে ১২০০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী এই ভ্যাকসিনের ৪০ কোটি ডোজ প্রস্তুত করছে প্রতিষ্ঠানটি। ১৩ই জুন ইউরোপিয়ান সরকারগুলোকে ৪০ কোটি ডোজ সরবরাহের একটি পৃথক চুক্তি করে অ্যাসট্রাজেনেকা। অপরদিকে বৃটিশ সরকার সর্বোচ্চ ১০ কোটি ডোজের জন্য অর্থ দেবে। এর মধ্যে ৩ কোটি হয়তো সেপ্টেম্বর নাগাদ বৃটিশ নাগরিকদের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
এ খবর দিয়েছে টেলিগ্রাফ।
জেডি১২২২ নামে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে মানুষ বাড়িতে আসা যাওয়া করতে পারবে, কাজে ফিরতে পারবে। অর্থনীতিও পুনরুদ্ধার করা যাবে। তবে বৃটিশ সরকার এই সতর্কতাও জারি করেছে যে, সম্পূর্ণ কার্যকর ভ্যাকসিন হয়তো কখনই পাওয়া যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারি বন্ধে একমাত্র দীর্ঘমেয়াদী কার্যকর সমাধান হলো কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন। কিন্তু এমনটা যে হবেই তার নিশ্চয়তা নেই। বৃটিশ সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা স্যার প্যাট্রিক ভ্যালেন্সও বলেছেন, কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবেই, তেমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
জানুয়ারিতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইন্সটিটিউট ও অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ কভিড-১৯ রোগের একটি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করে। ২৩শে এপ্রিল নাগাদ হিউম্যান ট্রায়ালের কাজ শুরু হয়। ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ৫১০ জন স্বাস্থ্যবান স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এই পরীক্ষা বর্তমানে চলছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা ৬ সপ্তাহের মধ্যে জানতে পারবেন এই ভ্যাকসিন কাজ করে কিনা।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিয়াস প্রফেসর অব মেডিসিন স্যার জন বেল বলেছেন, কয়েকশ বৃটিশ নাগরিককে এই পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে যে, মধ্য-জুন নাগাদ এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
হিউম্যান ট্রায়াল যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে চলছে দু’টি আর চীনে একটি।
বাণিজ্য মন্ত্রী শর্মা আরও বলেন, সরকারি সমর্থনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ‘বৈশ্বিক লাইসেন্সিং চুক্তি’তে উপনীত হয়েছে অ্যাসট্রাজেনেকা। তিনি বলেন, ‘এর অর্থ হলো যদি ভ্যাকসিনটি সফল হয় তাহলে অ্যাসট্রাজেনেকা সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩ কোটি ডোজ প্রস্তুত রাখতে কাজ শুরু করবে। মোট ১০ কোটি ডোজ সরবরাহ হবে যুক্তরাজ্যে।’
তিনি আরও জানান, এই ভ্যাকসিন সবার আগে যুক্তরাজ্যই পাবে। তবে সরকার এ-ও নিশ্চিত করবে যেন উন্নয়নশীল দেশগুলোও সম্ভাব্য সর্বনিম্ন খরচে এই ভ্যাকসিন পেতে পারে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক বলেছেন, সফল হলে প্রথম ৩ কোটি ডোজ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদেরই দেওয়া হবে।
এদিকে ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষকরা ৩০০ মানুষের মধ্যে আরেকটি ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল সম্পন্ন করবেন। তারা দেখবেন যে, এই পরীক্ষামূলক ডোজের ফলে ওই ব্যক্তিদের শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় কিনা। ১৮ থেকে ৭০ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবীরা সকলে ২টি করে ডোজ পাবেন। এই ট্রায়াল সফল হলে ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর ফের পরীক্ষা করা হবে।
ইমপেরিয়াল কলেজের গবেষণা অক্সফোর্ডের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। এই গবেষণাও চলছে বৃটিশ সরকারের দেওয়া ৪ কোটি ১০ লাখ পাউন্ড অনুদানে। এছাড়া ৫০ লাখ পাউন্ড অন্যান্য অনুদানও রয়েছে।
তবে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনকেই সবার আগে রাখছেন গবেষকরা। তবে ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধে অক্সফোর্ডের পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এতে বলা হয়, পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরও বানরগুলো (মন্টানা বানর, যাদের সঙ্গে মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার মিল রয়েছে) ওই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাবেক অধ্যাপক উইলিয়াম হ্যাসেলটাইন বলেন, ‘ভ্যাকসিন দেওয়া সব বানরই পরে আক্রান্ত হয়েছে, যেমনটা দেখা গেছে তাদের নসিকাগ্রন্থে ভাইরাসের জেনোমিক আরএনএ’র উপস্থিতি থেকে। ভ্যাকসিন না দেওয়া প্রাণী আর ভ্যাকসিন দেওয়া প্রাণীদের শরীরে প্রাপ্ত ভাইরাসের আরএনএ’র পরিমাণে কোনো তারতম্য ছিল না। অর্থাৎ, সব ভ্যাকসিনেটেড প্রাণীই আক্রান্ত হয়েছে।’ ড. হাসেলটাইন এইচআইভি/এইডস চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই তার বক্তব্যকেও সবাই গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনের ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক হিল বলেছেন, ওই নিবন্ধ বিভ্রান্তিকর, কেননা বানরগুলোকে অতিরিক্ত করোনাভাইরাস দেওয়া হয়েছে, যেন তাদের ওপর ব্যবহৃত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। তিনি বলেন, ‘সত্য কথা বলতে, লেখক হলেন অনেক আগে অবসরে যাওয়া হার্ভার্ডের একজন জ্যেষ্ঠ ভাইরোলজিস্ট ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি ঠিক ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করেননি।’
তবে অধ্যাপক হিল এ-ও স্বীকার করছেন যে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এখনও ফিফটি ফিফটি।
অপরদিকে ইমপেরিয়াল কলেজের গবেষকরা যেই ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন, তা শরীরে প্রয়োগ করা হলে পেশির কোষকে কভিড-১৯ ভাইরাসের প্রোটিন উৎপাদন করতে নির্দেশ দেবে। আর তা হলেই শরীরে একটি ইমিউন রেসপন্স তৈরি হবে, আর ভাইরাসের বিরুদ্ধে এক ধরণের ইমিউনিটি তৈরি হবে। অধ্যাপক রবিন শাটকের নেতৃত্বে একটি দল ওই ভ্যাকসিন ফেব্রুয়ারি থেকে প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করছেন। বাণিজ্য মন্ত্রী বলেছেন, ইমপেরিয়াল কলেজের গবেষণায়ও ভালো অগ্রগতি আছে। মধ্য-জুন নাগাদ এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হতে পারে। বড় ধরণের পরীক্ষা হতে পারে অক্টোবর নাগাদ।
যুক্তরাষ্ট্রেও চলছে মানব ট্রায়াল। সেখানেও একটি ভ্যাকসিনে প্রাথমিক সাফল্য পাওয়া গেছে। অল্প কয়েকজন মানুষের শরীরে ওই ভ্যাকসিন সুরক্ষামূলক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পেরেছে। ওই অ্যান্টিবডি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে প্রশিক্ষিত করবে।
সেখানকার ফার্মা প্রতিষ্ঠান মডার্নার প্রস্তুতকৃত এই ড্রাগ মানুষের শরীরে কভিড-১৯ ভাইরাসের জেনেটিক কোডের একটি ছোট নমুনা প্রবেশ করায়। সামান্য হলেও এ থেকেই মানুষের শরীরে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, আর অ্যান্টিবডি তৈরি হতে থাকে। এই গ্রীষ্মে পরীক্ষা কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা হবে।
মন্টানার গবেষণার ফলাফল নিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন বৃটিশ বিজ্ঞানীরাও। ইমপেরিয়াল কলেজে ভ্যাকসিন তৈরিতে নিয়োজিত অধ্যাপক রবিন শ্যাটক বলেছেন, শুরুটা ভালোই, তবে কার্যকারিতার উপাত্তই সব।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ভ্যাকসিন সম্পূর্ণ অনুমোদিত না হলেও আগেই তারা উৎপাদন শুরু করে দেবেন, যেন অনুমোদন পাওয়ার পর দ্রুতই বিতরণ শুরু করা যায়।
এসবের বাইরে যুক্তরাজ্যে জিএসকে ও সানোফি মিলে একটি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এর পরীক্ষা শুরু হতে পারে। অপরদিকে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের দ্বারপ্রান্তে থাকা একটি বেসরকারী বায়োটেক কোম্পানিতে ৩০ কোটি ইউরো বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে জার্মান সরকার। কিউরভ্যাক নামে ওই আলোচিত প্রতিষ্ঠানটির ২৩ শতাংশ মালিকানা কিনে নিয়েছে সরকার। এর আগে এই প্রতিষ্ঠানটি কিনে নিতে চেয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। তবে ওই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় জার্মানিতে।
এদিকে চীনা একটি ওষুধ কোম্পানিও তাদের একটি ভ্যাকসিনে প্রাথমিক ইতিবাচক ফলাফল পাওয়ার কথা জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তাদের ভ্যাকসিন যেসব রোগীকে দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই ইমিউন রেসপন্স দেখা দিয়েছে। চায়না ন্যাশনাল বায়োটেক গ্রুপ (সিএনবিজি) এই ভ্যাকসিন তৈরি করছে। সারাবিশ্বে মোট ২০০টির মতো ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাকও তাদের নিজস্ব ভ্যাকসিন থেকে ইতিবাচক ফল পাওয়ার কথা জানিয়েছে। তারা বলেছে, শিগগিরই ব্রাজিলে তৃতীয় দফার বৃহৎ পরীক্ষা শুরু করা হবে।
২০১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার বিস্তারের পর কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপায়ের্ডনেস ইনোভেশন্স (সিইপিআই) নামে একটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠন ভ্যাকসিন গবেষণায় একটি মাইলফক। যেকোনো ধরণের মহামারিতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে এই সংস্থার সৃষ্টি। এই প্রতিষ্ঠানটি মোট ৮টি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন তৈরি করছে। তবে এত ভ্যাকসিন থাকলেও বৃটেন সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা স্যার প্যাট্রিক ভ্যালেন্সের মুখে কেবল সতর্কতার সুর। তিনি বলেন, বর্তমানে যেসব ভ্যাকসিনের কাজ চলছে, এগুলো সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক দূরবর্তি বিষয়। খুব অল্প কিছু ভ্যাকসিনই শেষ পর্যন্ত সফল হয়। করোনাভাইরাসের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হবে না। বরং, এই ভাইরাসের নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। ফলে এতে সময় লাগবে।
ভ্যাকসিন তৈরির প্রধান বাধা হলো বড় আকারে উৎপাদন ও বিতরণ। ধারণা করা হচ্ছে যে, সিইপিআই’র প্রায় ২০০ কোটি ডলারের অর্থায়ন প্রয়োজন হবে। যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যেই ২৫ কোটি পাউন্ড প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে, যা যেকোনো দেশের জন্য সর্বোচ্চ।