গিবতের ভয়াবহতা ও পরিত্রাণের সাতটি উপায়

গিবত আরবি শব্দ। এর অর্থ পরনিন্দা করা, দোষচর্চা করা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা করা, দোষারোপ করা, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা।গিবত দুরারোগ্য ব্যাধির মতো, যা কর্মফল ধ্বংস করে দেয়। এখানে গিবত থেকে পরিত্রাণ লাভের কয়েকটি উপায় বর্ণনা করা হলো:গিবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হওয়া

গিবত থেকে বাঁচার জন্য সর্বপ্রথম এর ভয়াহতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা জরুরি।

কারণ কোনো কিছুর ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে সেই ক্ষতিকারক বিষয় থেকে সতর্ক থাকা যায় না। সুতরাং গিবত যে ভয়াবহ পাপ সেটা যদি কেউ না জানে এবং গিবতের স্বরূপ তার কাছে অস্পষ্ট থাকে, তবে তার মাধ্যমে গিবতের পাপ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সে যদি জানে গিবত সাধারণ কোনো গুনাহ নয়, এটা ব্যভিচার, সুদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতির চেয়েও মারাত্মক। এই পরনিন্দা ঋণের মতো, যা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে।
যার দোষ চর্চা করা হয়, কিয়ামতের দিন তাকে নিজের কষ্টার্জিত আমলের সওয়াব বাধ্য হয়ে দিতে হবে। আর যদি নিজের সওয়াব না থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির পাপের বোঝা গিবতকারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে উল্টোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এসব বিষয় কেউ অবহিত হলে তার জন্য গিবত পরিহার করা অনেকটা সহজ হবে।কল্যাণকর কথা বলা নতুবা চুপ থাকা বেশির ভাগ গিবত কথাবার্তার মাধ্যমে হয়ে থাকে।

সে জন্য প্রয়োজনীয় কথা বলা ছাড়া মুখটাকে বন্ধ রাখতে পারলে নানা ধরনের পাপ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬১৩৬)আল্লাহর জিকিরে জিহ্বা সিক্ত রাখা

জিকির বান্দাকে গিবতের পাপ থেকে পরিচ্ছন্ন রাখে। আল্লাহর স্মরণে সিক্ত জিহ্বা সর্বদা কল্যাণকর কাজে ব্যস্ত থাকে। ফলে নানা রকম পাপের পঙ্কিলতা থেকে ব্যক্তি সুরক্ষিত থাকে।

ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে গিবত, চোগলখুরী, মিথ্যা ও অশ্লীলতার মতো গর্হিত কথাবার্তা থেকে জিহ্বাকে মুক্ত রাখা যায়। মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হলো সে চুপ থাকতে পারে না। কোনো না কোনো কথা তাকে বলতেই হয়। সে জন্য আল্লাহর জিকিরে রসনাকে ব্যস্ত রাখা না হলে এবং শরিয়তের বিধি-বিধানের ব্যাপারে আলোচনা করা না হলে জিহ্বা হারাম ও রবের অসন্তুষ্টিমূলক কথাবার্তায় লিপ্ত হবেই। আল্লাহর জিকির ছাড়া এটা থেকে উত্তরণের বিকল্প কোনো পথ নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এ কথা দিবালোকের মতো প্রমাণিত যে কেউ যদি স্বীয় রসনাকে আল্লাহর জিকিরে ব্যস্ত রাখতে পারে, তবে সে অন্যায় কথাবার্তা থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পারবে। আর তার জিহ্বা জিকির থেকে নীরস-শুষ্ক থাকলে তার জিহ্বা বাতিল, অনর্থক ও অশ্লীল কথা দ্বারা সিক্ত হবে।’ (ইবনুল কাইয়িম, আল-ওয়াবিলুছ সায়্যিব, ১/৯৮)গিবতকারীদের মজলিস পরিত্যাগ করা

গিবতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে পরিবেশ ও সঙ্গ। অনেক সময় বাধ্য হয়ে গিবত শুনতে হয়, অথচ গিবত শোনাও সমান গুনাহ। মজলিসে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গল্পচ্ছলে গিবত হয়ে যায়। সে জন্য নিন্দুক ও গিবতকারীর সঙ্গ ও বৈঠক পরিত্যাগ করা উচিত। গিবতকারীকে যদি বাহ্যিক দ্বিনদারও মনে হয়, তবু তার ব্যাপারে সতর্ক-সাবধান থাকা অপরিহার্য।

ইবনুল মুবারক (রহ.) মসজিদে সালাত আদায় করার পরে কারো সঙ্গে কোনো গল্প করতেন না। সোজা বাড়িতে চলে যেতেন। একদিন শাকিফ ইবনে ইবরাহীম বলখি (রহ.) তাঁকে বলেন, ‘আচ্ছা! আপনি তো আমাদের সঙ্গেই সালাত আদায় করেন, কিন্তু আমাদের সঙ্গে বসেন না কেন?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ফিরে গিয়ে সাহাবি ও তাবেঈদের সঙ্গে বসে কথা বলি।’ আমরা বললাম, ‘সাহাবি-তাবেঈদের আপনি কোথায় পেলেন’? তিনি বলেন, ‘আমি ফিরে গিয়ে ইলমচর্চায় মনোনিবেশ করি। তখন তাদের কথা ও কর্মের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তোমাদের সঙ্গে বসে আমি কী করব? তোমরা তো একত্রে বসলেই মানুষের গিবত করা শুরু করে দাও।’ (সিফাতুছ সাফওয়াহ : ৩/৩২৪)

নিজের ভুলত্রুটির দিকে মনোনিবেশ করা

মানুষ মাত্রই দোষত্রুটি বিদ্যমান। কারোটা প্রকাশ পায়, কারোটা পায় না। সে জন্য নিজের দোষত্রুটি নিয়ে অধিক চিন্তা করা উচিত, তাহলে ভুল সংশোধন সহজ হবে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যদি তোমার বন্ধুর ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা মনে করতে চাও, তবে নিজের দোষত্রুটির কথা স্মরণ করো। (ইবনু হাজার হায়তামি, আজজাওয়াজির : ২/১৮)

গিবতের কাফফারা

গিবতের পাপের গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার উপায় হচ্ছে, যার গিবত করা হয়েছে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া। যেমন—আবু বকর ও উমর (রা.) একবার নিজেদের মধ্যে তাদের এক খাদেমের অনুপস্থিতিতে তার বেশি ঘুমানোর ব্যাপারে আলোচনা করেন। সামান্য এই গিবতের কারণে রাসুল (সা.) পরে তাদের বলেন যে আমি তোমাদের উভয়ের দাঁতের মধ্যে তার গোশত দেখতে পাচ্ছি। অতঃপর তারা রাসুল (সা.)-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাদেরকে তাদের খাদেমের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। (সিলসিলা সহিহাহ, হাদিস : ২৬০৮)

তবে সরাসরি ক্ষমা চাইতে গেলে যদি ফিতনা সৃষ্টি হয়, তাহলে নিজের জন্য ও তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এবং যে স্থানে তার কুৎসা রটনা করা হয়েছে সেখানে তার প্রশংসা করতে হবে। (আল-ওয়াবিলুস সাইয়েব, ইবনুল কাইয়িম, পৃষ্ঠা-১৪১)

এ প্রসঙ্গে হুজায়ফা (রা.) বলেছেন, ‘গিবতের কাফফারা হচ্ছে—যার গিবত করা হয়েছে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।’ (বাহজাতুল মাজালিস, ইবনু আবদিল বার, পৃষ্ঠা-৮৬)

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.