গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন: চা শ্রমিকদের মধ্যে কুষ্ঠ বিশ্বে সর্বোচ্চ
অলোকা গঞ্জুর বাঁ হাতের ত্বক বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। সেদিকে তাঁর নজরই ছিল না। পরে দেখলেন, হাতের আঙুলগুলো জড়িয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং চা পাতা তুলতে সমস্যা হচ্ছে। ৪৭ বছরের অলোকা বলেন, ‘কী হচ্ছে, আমার কোনো ধারণাই ছিল না।’ সিলেটের এ চা শ্রমিকের রোজগারের ওপর নির্ভরশীল তাঁর স্বামী, চার সন্তান ও তিন নাতি-নাতনি। চিকিৎসার জন্য অলোকা যখন গেলেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে! বাঁ হাতটাই অকেজো হয়ে পড়েছে, যা সারিয়ে তোলার আর্থিক সামর্থ্য তাঁর নেই।
শুক্রবার দ্য গার্ডিয়ান অনলাইনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, চা শ্রমিক অলোকা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিপ্রোসি মিশনের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে কর্মী রয়েছেন ছয় লাখের মতো, যাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বিশ্বে কুষ্ঠ আক্রান্তের হার তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত বছর দেশে ২ হাজার ৯৭৪ জনের কুষ্ঠ শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ২০০ জন প্রতিবন্ধিতার শিকার। এর মধ্যে শুধু মৌলভীবাজার জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬৬০ জন। এ কারণে জেলাটিকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালে শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৮৭২। তাঁদের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার হন ১৬৫ জন।
১০ বছর ধরে দেশে বছরে গড়ে ৩ হাজার কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। এ রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলো হলো– মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট ও মেহেরপুর। মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকাসহ ছয় জেলা। নিম্ন ঝুঁকিতে আছে ৩৪টি জেলা।
লিপ্রোসি মিশন আফ্রিকা ও এশিয়ার ১০টি দেশে কাজ করে। তারা জানায়, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চা শ্রমিকদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৫ জনের বেশি। অধিকাংশ পরিবারেই কেউ না কেউ আক্রান্ত। দেশে লিপ্রোসি মিশনের আবাসিক চিকিৎসক বেঞ্জামিন রোজারিও গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘সিলেটের চা বাগানগুলোয় কুষ্ঠ দ্রুতই ছড়াচ্ছে। এমনটা আমাদের দল আর কোথাও লক্ষ্য করেনি।’ কুষ্ঠ আক্রান্তদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণবিরোধী জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি এলাইস ক্রুজ গত মাসে সতর্ক করে বলেন, এমন অনেক আক্রান্ত থাকতে পারেন, যাঁদের শনাক্ত করা হয়নি।
কুষ্ঠ পৃথিবীর অবহেলিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটা মূলত আর্দ্র বাতাসে ছড়ায়। চা শ্রমিকরা ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে থাকেন। তাঁদের সুষম খাবার ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। ওষুধের মাধ্যমে কুষ্ঠ ঠেকানো যায়। তবে এটি অক্ষমতা দূর করতে পারে না।
লিপ্রোসি মিশন জানায়, ২০১৭ সালে সিলেটের বিভিন্ন বাগানে কার্যক্রম শুরুর পর ১ হাজার ৬০০ জনের কুষ্ঠ সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তারা। চা বাগানে সংস্থাটি অস্থায়ী হাসপাতাল করেছে, সেখানে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন।
১৯৯৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশকে ‘কুষ্ঠমুক্ত’ ঘোষণা করে। এর অর্থ হচ্ছে, দেশে কুষ্ঠ আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি ১০ হাজারের একজনেরও কম। এর পরও সংস্থাটির তথ্যমতে, বিশ্বে কুষ্ঠ আক্রান্তের সংখ্যায় বাংলাদেশ পঞ্চম।
মৌলভীবাজারের মেয়র ফজলুর রহমান বলেন, ‘ডব্লিউএইচও বাংলাদেশকে কুষ্ঠমুক্ত ঘোষণা করলেও এখানে তহবিল সরবরাহ ও রোগ শনাক্তের প্রক্রিয়ায় ঘাটতি আছে।’ মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ সমকালকে বলেন, জেলায় চা বাগান ৪৫টি। এসব বাগানের শ্রমিকরা অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেন। এ কারণে এই রোগের প্রকোপ বেশি। চা বাগানে এখন কুষ্ঠ শনাক্তে কর্মসূচি জোরদার করা হয়েছে। এ জন্য রোগী শনাক্ত বেড়েছে। সরকার তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মোহাম্মদ নূরে আলম শামীম বলেন, শুধু কুষ্ঠ নয়, চা বাগানে অন্য রোগের সংক্রমণও বেশি। চা শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে।
জাতীয় কুষ্ঠ রোগ নির্মূল কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও উপপরিচালক ডা. ইউনূস আলী বলেন, কুসংস্কারের কারণেই কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেলেও মানসিক ও সামাজিক নিগ্রহের শিকার হওয়ার ভয়ে রোগীরা প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালে যান না।