গভীর রাতে আটক যুবদল নেতার মৃত্যু, শরীরে আঘাতের চিহ্ন

কুমিল্লায় যৌথ বাহিনীর হাতে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাড়ি থেকে আটক হওয়ার পর এক যুবদল নেতার মৃত্যু হয়েছে।শুক্রবার (৩১) সকালে তার মৃত্যুর খবর পান পরিবারের সদস্যরা। তার নাম মো. তৌহিদুল ইসলাম (৪০)।

অমানবিক নির্যাতনের কারণে তৌহিদুল মারা গেছেন বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবারে। নিহতের শরীরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন থাকার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক ও স্বজনেরা।

তৌহিদুল ইসলাম কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি একই ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের বাসিন্দা। তৌহিদুল চট্টগ্রাম বন্দরে একটি শিপিং এজেন্টে চাকরি করতেন।

গত রবিবার তাঁর বাবা মোখলেছুর রহমানের মৃত্যুর খবরে তিনি বাড়ি আসেন বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। শুক্রবার তাঁর বাবার কুলখানি হওয়ার কথা ছিল। তৌহিদুলের মা প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। সংসারে তাঁর স্ত্রী ও চার কন্যাসন্তান রয়েছে।

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ সাইফুল মালিক সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে থানা–পুলিশকে বলা হয় তৌহিদুল ইসলামকে নেওয়ার জন্য। যখন পুলিশের কাছে তৌহিদুলকে হস্তান্তর করা হয়, তখন তিনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, তৌহিদুলকে কেন আটক করা হয়েছিল বা কীভাবে তিনি মারা গেছেন, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। প্রাথমিকভাবে খোঁজ নিয়ে তৌহিদুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ঘটনার পর এ বিষয়ে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য জানানো হয়নি।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তৌহিদুল ইসলামের ভাই সাদেকুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তাঁরা বাবার কুলখানির আয়োজন নিয়ে কাজ করছিলেন। রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে পুলিশের পোশাক পরা কাউকে দেখেননি, তবে সাদা পোশাকে পাঁচজন যুবক ছিলেন। বাড়িতে প্রবেশ করেই তাঁরা তৌহিদুলকে আটক করেন। এরপর সবার কাছ থেকে মুঠোফোন কেড়ে নেন। ঘরে ব্যাপক তল্লাশি করেন। তবে কিছু পাননি। তৌহিদুলকে আটকের কারণ জিজ্ঞস করলেও তাঁরা কোনো উত্তর দেননি। একপর্যায়ে তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে যান।

সাদেকুর রহমান বলেন, শুক্রবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে ফোন করে দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে বলেন। হাসপাতালে আসার পর দেখেন তৌহিদুল আর নেই। তাঁর কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত এমনভাবে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে যে কালো ফোলা জখমের চিহ্ন রয়েছে। পেট, বুক, পিঠ, পা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে শুধুই নির্যাতনের চিহ্ন।

তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, থানায় একটি জিডিও নেই উল্লেখ করে সাদেকুর রহমান বলেন, বাড়ির পাশের একটি পরিবারের সঙ্গে তাঁদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ চলছে। সেই বিরোধকে কেন্দ্র করে তৌহিদুলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হতে পারে। তৌহিদুলের কাছে অস্ত্র রয়েছে—এমন কোনো ভিত্তিহীন তথ্য দেওয়া হতে পারে। যার কারণে তাঁকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।

শুক্রবার বিকেলে ইটাল্লা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার স্বামীর জন্য বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। স্বামীর মরদেহ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে আসার অপেক্ষায় আছেন তাঁরা। ইয়াসমিনকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছে তৌহিদুলের শিশু ও কিশোরী চার কন্যা। বাবাকে হারিয়ে মায়ের সঙ্গে দিশাহারা তারাও।

ইয়াসমিন নাহার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার চারটা মেয়ে এখনো ছোট। আমি এখন কী করব, মেয়েগুলোকে নিয়ে কীভাবে বাঁচব? আমার স্বামী তো কোনো অপরাধ করেনি। তাহলে কেন আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে এভাবে হত্যা করা হলো। আমি পুরো ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং বিচার চাই।’

২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তৌহিদুল ইসলাম। তাঁর বিরুদ্ধে কখনোই কোনো অভিযোগ পাননি বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের সদস্যসচিব ফরিদ উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই যুবদল নেতারা হাসপাতালে যান। তাঁকে শুধু পেটানোই নয়, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ইলেকট্রিক শকও দেওয়া হয়েছে বলে জেনেছেন। এমন একজন মানুষের এভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। তাঁরা পুরো ঘটনার তদন্ত চান।

তৌহিদুল ইসলামকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন কোতোয়ালি মডেল থানার উপপরিদর্শক মোরশেদ আলম। তিনি জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে থানার ডিউটি অফিসার জানান যৌথ বাহিনী আদর্শ সদর উপজেলার ঝাঁকুনিপাড়া এলাকায় গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ সড়কে দ্রুত যাওয়ার জন্য বলেছে। পরে ওসিকে বলে তিনি গাড়ি নিয়ে যান। তখন যৌথ বাহিনী তৌহিদুলকে নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু তৌহিদুলের অবস্থা খারাপ দেখে তাদেরও সঙ্গে যেতে বললে তারা রাজি হয়নি। পরে তিনি তৌহিদুলকে হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তানভীর আহমেদ বলেন, শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ তৌহিদুল ইসলামকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেখা যায় হাসপাতালে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.