খরচের ফাঁদে হিমশিম: নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ইফতার-সাহরিতে ‘কাটছাঁট’
পোশাক শ্রমিক শেফালী বেগম। স্বামী কবির মিয়া রিকশাচালক। সন্তানসহ পাঁচ সদস্য নিয়ে এই দম্পতির পরিবার। দুজন উপার্জনক্ষম হলেও টেনেটুনে চলছে তাদের সংসার। বাসা ভাড়া, খাবার, সন্তানের স্কুল খরচ, ওষুধসহ নিত্যনতুন খরচের ফাঁদে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারটি। অন্য বছর রমজান নিয়ে তাদের আলাদা পরিকল্পনা থাকলেও এবার নেই। খরচের লাগাম টেনে ধরতে খাবারের পরিমাণ কমিয়েছেন তারা। কাটছাঁট করছেন ইফতার-সাহরিতেও। মুড়ি, ছোলা, পানি দিয়ে কোনোমতে সারছেন ইফতার।
শুধু শেফালি-কবির দম্পতি নন, আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমজানে টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন তারা। নিত্যপণ্যের দাম গতবারের তুলনায় অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিটি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে। আয়ের তুলনায় ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় কূল-কিনারা করতে পারছেন না তারা।
রাজধানীর শনির আখড়া এলাকার বাসিন্দা রিকশা শ্রমিক মাসুম মিয়া বলেন, বর্তমানে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। প্রতিনিয়ত ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু আমাদের ইনকাম বাড়ছে না। গরিবরা গরিবই থাকে। তাদের ভাগ্য আর বদলায় না। গত রমজানে ইফতারে ছোলা, পেঁয়াজু, চপ, শরবত থাকলেও এবার ডাল, ভাত আর শাক বা সবজি দিয়ে ইফতার করছি। সাহরিতেও তাই খাচ্ছি।
স্বল্প আয়ের লাখ লাখ পরিবার একইভাবে ইফতার ও সাহরি থেকে দুই-তিন কিংবা তারও বেশি আইটেম কাটছাঁট করছেন। অনেকে আবার ইফতারে আইটেম পরিবর্তন করে কম খরচের কথা চিন্তা করে ভাত-শাক খাচ্ছেন। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে অতি দরিদ্র অনেকের খাবারের রুটিন থেকে ‘ইফতারি’ শব্দটিই যেন উঠে যাচ্ছে। তারা শুধু পানি মুখে দিয়ে রোজা ভেঙে রাতের খাবার খেয়ে থাকেন।
যাত্রাবাড়ীর মুদি ব্যবসায়ী রবি সাহা বলেন, ‘এবার রমজানে বেচাকেনা ভালোই চলছে। তবে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ চলছে কষ্ট করে। তারা খাবার কমিয়ে দিয়েছে। আগে যে ৫-৭টি আইটেম নিত সে এখন ২-৩টি নিচ্ছে।’
খাবারে এমন কাটছাঁটে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা দৈনন্দিন খাদ্য জোগানে আমিষ, ভিটামিন, খনিজসহ মানবদেহের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। দামের কারণে ন্যূনতম পরিমাণ সবজি, ফল, দুগ্ধজাত খাবার ও আমিষজাতীয় খাবার অনেকই পরিবারই জোগাড় করতে পারছে না। মানুষ পরিবারে খাবারের পেছনে যে ব্যয় হয় সেটি কাটছাঁট করছে বা কমিয়ে আনছে। ফলে পুষ্টিকর খাবারের কাঠামোয় পরিবর্তন আসছে। দেশের অনেক পরিবার পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা অনুযায়ী শাকসবজি, ফলমূল, দুগ্ধজাত খাবার, মাংস ও মাছ গ্রহণের মাত্রা আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
এদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাজার পরিস্থিতি অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি পাচ্ছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা নিয়মিত মনিটরিং করছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও বাদ সাধছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কোনো কোনো পণ্যে ভোক্তার পকেট কাটছে সুযোগ সন্ধানীরা। রমজান এলেই অতি মুনাফালোভী কতিপয় ব্যবসায়ী সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
পুষ্টিবিদ শারমিন আরা বলেন, মূল্যস্ফীতির ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারছে না। এ যেন ইচ্ছা আছে সাধ্য নেই অবস্থা। তিনি বলেন, পুষ্টিকর খাবার মানেই যে প্রতি বেলায় মাছ, মাংস থাকতে হবে এমনটি নয়। এমন কিছু খাবার আছে যেগুলো দামে কম হলেও পুষ্টির দিক থেকে খুব ভালো কাজে দেয়। খরচ কমিয়ে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সম্ভব, যদি সহজলভ্য এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারগুলো বেছে নেওয়া যায়।
সাশ্রয়ী দামে পুষ্টিকর ৫ খাবার: পুষ্টিবিদরা জানান, এমন কিছু খাবার আছে যেগুলো দামে সাশ্রয়ী কিন্তু পুষ্টিসমৃদ্ধ। এমন পাঁচটি খাবার হলো-
১. ডাল: ডাল প্রোটিনের একটি ভালো উৎস এবং দামেও সাশ্রয়ী। মুগ, মসুর, কিংবা ছোলার ডাল রান্না করে বা স্যুপ আকারে খাওয়া যায়। ডালে প্রচুর ফাইবার, আয়রন, এবং ভিটামিন বি থাকে।
২. ডিম: ডিম হলো সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য একটি পুষ্টিকর খাবার। এতে প্রোটিন, ভিটামিন ডি, এবং সঠিক পরিমাণে চর্বি রয়েছে। এটি নাশতা বা যেকোনো সময়ের খাবারে যোগ করা যায়।
৩. মিষ্টি আলু: মিষ্টি আলু কার্বোহাইড্রেটের ভালো উৎস এবং এটি ভিটামিন এ-তে সমৃদ্ধ। এটি সিদ্ধ বা ভর্তা করে সহজেই খাওয়া যায়। এটি অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায় বলে খরচ কমানো যায়।
৪. সবজি (লাউ, পুঁইশাক, কচু): মৌসুমি শাকসবজি যেমন লাউ, কুমড়া, পুঁইশাক বা কচুর শাক সাশ্রয়ী এবং পুষ্টিকর। এগুলো ভিটামিন, মিনারেল, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে।
৫. চিড়া ও কলা: চিড়া সহজলভ্য, সস্তা এবং হালকা খাবার হিসেবে চমৎকার। এটি কার্বোহাইড্রেটের ভালো উৎস। কলার সঙ্গে চিড়া খেলে প্রোটিন, পটাশিয়াম, এবং ফাইবার মিলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ খাবার তৈরি হয়।