ক্ষমতা দেখাতে বাহিনী গড়ছে কিশোর-তরুণরা, বাড়ছে অপরাধ

দেশজুড়ে বেড়েছে অপরাধ। এসব অপরাধের মূলে রয়েছে কিশোর-তরুণ গ্যাং। ক্ষমতা দেখাতেই উঠতি কিশোর-তরুণরা মিলে পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন নামে বাহিনী গড়ে তুলছে। এরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ, মাদক কারবার, জমি দখলে সহায়তা এবং যৌন হয়রানির মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়াচ্ছে। এমনকি ব্যাংক ডাকাতি বা চলন্ত বাসে উঠে গলায় ছুরি ধরে ছিনতাইও করছে।

অভিযোগ রয়েছে, কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের পেছনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। তাদের ইন্ধন দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতাসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীরা।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ৪০ শতাংশই কিশোর। দেশে বর্তমানে আড়াই শতাধিক কিশোর-তরুণ গ্যাং রয়েছে। রয়েছে ৫ হাজারের বেশি সদস্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নামে কিশোর-তরুণ গ্যাং হলেও এসব অপরাধী চক্রের বেশিরভাগ সদস্যের গড় বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। অবশ্য এসব গ্রুপে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সিরাও রয়েছে। এসব কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের প্রত্যেকটির সদস্যদের রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। তাদের রয়েছে ভিন্ন নাম, স্থান, ড্রেস কোড ও চুলের স্টাইল, চালচলনও আলাদা। দলের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং স্কুল বা কলেজপড়ুয়া। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এবং লেখাপড়া না জানা কিশোর-তরুণও রয়েছে এসব দলে।

                             ফেনীতে র‍্যাবের হাতে আটক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি দেশের পটপরিবর্তনের পর কিশোর অপরাধের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থায় কিছুটা ঘাটতিও আছে, এ ঘাটতি সমাজব্যবস্থায়ও রয়েছে। কিশোর অপরাধীদের শাস্তির চেয়ে সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। তবে এ কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এতে কিশোর অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

ঢাকায় আদাবর ও মোহাম্মদপুরে কিশোর-তরুণ গ্যাং সবচেয়ে বেশি। এ দুই এলাকায় রয়েছে ২ হাজারের বেশি সদস্য। আদাবর এলাকার আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখের টেক ও ঢাকা উদ্যান এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। অপরাধের হটস্পট মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকা। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প মাদকের স্বর্গরাজ্য। এ জেনেভা ক্যাম্প প্রতিনিয়ত ঘটছে বিভিন্ন অপরাধ। একইসঙ্গে আদাবর, ধানমন্ডি, মিরপুরের বিহারি ক্যাম্প এবং কালশী বস্তি, পল্লবী ঝিলপাড়, রূপনগর, বংশাল, লালবাগ, উত্তরা, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে অসংখ্য কিশোর-তরুণ গ্যাং।

অনুসন্ধান সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুরে ডাইল্লা গ্রুপ, এলেক্স গ্রুপ, ইমন গ্রুপ, আনোয়ার ওরফে শুটার আনোয়ার গ্রুপ, আকাশ গ্রুপ, দ্য কিং অব লও ঠেলা গ্রুপ, ডায়মন্ড গ্রুপ, আই ডোন্ট কেয়ার (আইডিসি), মুরগি গ্রুপ, সাব্বির গ্রুপ, শাওন গ্রুপ, ফিল্ম ঝিরঝির, স্টার বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপাইয়া দে গ্রুপ। উত্তরা এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিল বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার, তুফান। মিরপুর এলাকায় আছে সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারি রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং।

ধানমন্ডিতে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড। বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং, তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং, মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, পানিটোলা, লালকুঠি, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজারসহ সদরঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ফেরদৌস গ্রুপ, সাজু গ্রুপ, সিনিয়র গ্রুপ, জুনিয়র গ্রুপ, টাইগার গ্রুপ, চিতা গ্রুপ।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় শুরু হয় গণছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। কিশোর-তরুণ গ্যাং গ্রুপের মহড়া চলে আদাবরে রাস্তায় রাস্তায়। বেড়ে যায় ছিনতাই। আধিপত্য বিস্তার বা পূর্বশত্রুতার জেরে জোড়া খুনের ঘটনাও ঘটে মোহাম্মদপুর রায়েরবাগ এলাকায়। এসব অপরাধে জড়িত রয়েছে একাধিক কিশোর-তরুণ গ্যাং গ্রুপ। এ বছরের শুরুতে গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আদাবরের মেহেদীবাগ, আদাবর বাজার এলাকায় দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় কিশোর-তরুণ গ্যাং সদস্যরা।

সম্প্রতি মোহাম্মদপুর এলাকায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত সন্দেহে  ৪১ জনকে আটক করে পুলিশ।  ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, পুলিশের মাসিক ক্রাইম করফারেন্সেও কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কী কী করণীয়, তা নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়। এরই মধ্যে গত ৫ মাসে সারা দেশে প্রায় ১ হাজার কিশোর-তরুণ অপরাধী চক্রের সদস্য আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়। এখনো এ অপরাধীচক্রের কয়েক হাজার সদস্য নজরদারিতে রয়েছে।

পুলিশ বলছে, শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীই নয়, এ অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে পরিবারের মা-বাবাসহ স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া অভিভাবকদের সঙ্গেও তারা নিয়মিত কথা বলছেন। থানা করিডরে তাদের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত উঠান বৈঠক করা হয়।

কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের অপরাধ : গত ৬ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর আদাবর ১৬ নম্বর রোডের একটি বাসায় লকার ভেঙে ৪৫ ভরি সোনা লুটের ঘটনায় দুই কিশোরকে আটক করে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় জড়িত আরো অনেক কিশোর-তরুণ এখনো আটক হয়নি। গত ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় এক পথশিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রায়হান নামে এক তরুণকে আটক করে পুলিশ।

আদাবরে একটি বাড়িতে লকার ভেঙে ৪৫ ভরি সোনা লুটের ঘটনায় আটক দুই কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

গত ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রায়েরবাজারে সাদেক খান কাঁচাবাজার এলাকায় কিশোর গ্যাং ‘ডাইল্লা গ্রুপ’ ও ‘এলেক্স গ্রুপের’ মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে নাসির (৩০) ও মুন্না (২২) নামে দুজন নিহত হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে মাহবুব নামে এক তরুণ স্ত্রী ও মাকে থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান দেখার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। ওইদিন রাত দেড়টায় লালবাগের জেএন সাহা রোডে একটি বাড়ির ভেতরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য মো. মাঈন উদ্দিনসহ ১৪-১৫ জন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মাহবুবকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে এবং লালবাগের লিবার্টি ক্লাবসংলগ্ন রাস্তায় তার লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

এ ঘটনায় ৪ জানুয়ারি রাতে লালবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাহবুব হত্যার সঙ্গে জড়িত গ্যাং গ্রুপের সদস্য মো. মাঈন উদ্দিনকে (২৬) গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করেছে। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার মাঈন ও ভুক্তভোগী মাহবুব লালবাগ এলাকায় দুটি গ্রুপের (গ্যাং) সদস্য। মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে আগে থেকেই বিরোধ ছিল। গত ২২ ডিসেম্বর বিকালে লালবাগ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে মাহবুবকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেছিল মাঈন উদ্দিন। হাসপাতাল থেকে মাহবুব সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে ১ জানুয়ারি তাকে হত্যা করা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘কিশোর নয়, ডিএমপি এলাকায় যেকোনো অপরাধ হলে আমরা তাদের গ্রেপ্তার করি। কিশোর গ্যাংয়ের স্পটগুলো চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হবে। তবে অপরাধীকে কিশোর বলে চিহ্নিত না করে অপরাধী বলে চিহ্নিত করতে হবে।’

কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এনামুল হক সাগর বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি। দ্রুতই কিশোর-তরুণদের অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। তবে অপরাধীকে কোনো বয়সে চিহ্নিত না করে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করাই ভালো।’

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, বয়সে তরুণ-কিশোররাই সাধারণত অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তারা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। যদিও তারা এসব অপরাধে আগেও জড়িত ছিল। তবে বর্তমানে কৌশল পরিবর্তন করছে। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে। কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে শাস্তির চেয়ে সংশোধনের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.