কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ঋণ ও এসএমই কার্ড প্ল্যাটফর্ম গঠনে যে বিপ্লব আসতে পারে
মোঃ সাইফুল আলম তালুকদার
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, কেনিয়া, ভারত সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল ক্রেডিট কার্ড বা তাৎক্ষণিক ঋণ প্রকল্প চালু করেছে, যাতে দ্রুত অর্থপ্রবাহ, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি, ঋণ প্রাপ্তি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সহজ হয়।
আমরা জানি যে প্রতিবছর টাকা ছাপানো, সংরক্ষণ ও পরিচালন বাবদ প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, যেই খরচ প্রতিবছর বাড়ছে। নগদ টাকা-বিহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে উক্ত খরচ বাঁচিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ঋণ ও সিএসএমই কার্ড প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা সম্ভব, যা ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মূল ভিত্তি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সবার জন্য ব্যাংক ও এমএফএস ওয়ালেটের ভেতর লেনদেন উন্মুক্ত করেছে এবং সেই সাথে শীঘ্রই ক্রেডিট ব্যুরো, ডিজিটাল ব্যাংক ও ওপেন ব্যাংকিং নীতিমালা চালুর পরিকল্পনা করছে। এগুলো কার্যকর হলে এমন কার্ড চালু করা আরও সহজ হবে।
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এসএমই ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক যৌথভাবে একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারে। যেখানে উদ্যোক্তার আর্থিক ইতিহাস ও লেনদেনের উপর ভিত্তি করে ঝুঁকি নির্ধারণ সাপেক্ষে একটি প্রি-অ্যাপ্রুভড ক্রেডিট লাইন চালু থাকবে। এটি শুধু ক্ষুদ্র ব্যবসা নয়, বরং সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির এক নতুন দিক উন্মোচন করতে নিঃসন্দেহে সাহায্য করবে।
ইন্দোনেশিয়া ২০২০ সালের পর ডিজিটাল ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প চালু করে, যার আওতায় ব্যাংক ও ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল কার্ড ইস্যু করে। ডিজিটাল কার্ডের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াই মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারে। এই স্কিমে সরকার সুদে ভর্তুকি দেয়, আর ব্যাংক ঝুঁকি ভাগাভাগি করে সরকারের গ্যারান্টি স্কিমের মাধ্যমে। যার ফলে ২০২৪ সালের মধ্যে তিন কোটিরও বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসা এই ডিজিটাল কার্ডের মাধ্যমে অর্থায়নের আওতায় আসে।
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে শরিয়াহ-সম্মত এসএমএই ঋণও ডিজিটাল চ্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে এই কার্ডের মাধ্যমে সরকার সরাসরি ডিজিটাল লেনদেনে কর সুবিধা প্রদান করছে, যাতে ব্যবসায়ীরা নগদ অর্থের বদলে ডিজিটাল লেনদেনকে অগ্রাধিকার দেয়। কেনিয়াতে মোবাইল অপারেটর ও ব্যাংক মিলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য মোবাইল ক্রেডিট লাইন দেয়ার পরিপেক্ষিতে ৫০%-এর বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে, যাদের আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্টই ছিল না।
ভারত ‘উদ্যম’ রেজিস্ট্রেশনের মতো একটি জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ডেটাবেস তৈরি করেছে। আর ফিলিপাইন সরকার এই কার্ডের জন্য ক্রেডিট স্কোরিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ব্যবসার বিক্রয় তথ্য, ইউটিলিটি বিল, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিটিও বিবেচনায় নিচ্ছে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে।
কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ঋণ ও এসএমই কার্ড প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার আগে এর লক্ষ্য, কার্যবিধি, প্রযুক্তি, ঝুঁকি-নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে যেন নীতিনির্ধারক, ব্যাংক এবং ফিনটেক সবাই একইভাবে বুঝতে ও কাজে লাগাতে পারে।
ডিজিটাল এসএমই কার্ড হবে ব্যাংক/ফিনটেক কর্তৃক ইস্যুকৃত একটি প্রি-অ্যাপ্রুভড ক্রেডিট লাইন যা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রয়োজন মেটাবে। দ্রুত ডিজিটাল অনবোর্ডিং ও লেনদেন-ভিত্তিক ক্রেডিট স্কোরিংয়ের মাধ্যমে, জামানত কমিয়ে বা জামানত ছাড়া তাৎক্ষণিক ঋণ অনুমোদন নিশ্চিত করবে। তবে কার্ড ভিত্তিক ঋণ অনুমোদনের সীমা ব্যবসার আকার ও ঝুঁকি অনুযায়ী স্তরভিত্তিক হবে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবার বাইরে আছে। ডিজিটাল এসএমই কার্ড দ্রুত অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত করে ব্যবসার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করবে, আর ব্যাংক/ফিনটেকদের কাছে নতুন গ্রাহক ও ডেটা-ভিত্তিক ঋণ প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে এর প্রধান প্রধান উদ্দেশ্য হবে: ১) অল্প কাগজপত্রে দ্রুত ও নিরাপদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ নিশ্চিত করা, ২) আনুষ্ঠানিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো, ৩) ডিজিটাল পেমেন্ট-নির্ভর ঋণ প্রদান ব্যবস্থা গঠন করা, ৪) ব্যাংক ও ফিনটেকের জন্য ঝুঁকি-নিয়ন্ত্রণে উন্নত ডেটা ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পরিশেষে ৫) নগদ-বিহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
এই কার্ড পেতে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে লাগবে জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর, এমএফএস একাউন্ট বা ব্যাংক ট্রানজাকশন ইতিহাস এবং ব্যবসার বর্ণনা। কোনো ব্যবসা অনানুষ্ঠানিক হলেও লেনদেনের ট্র্যাক থাকলে সেটি যোগ্য বলে ধরা যেতে পারে।
এই কার্ডের জন্য আবেদন পুরোপুরি অনলাইনে বা মোবাইল অ্যাপে করা যাবে। আবেদনকারীর পরিচয় যাচাই হবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে। এরপর ব্যাংক বা ফিনটেক প্রতিষ্ঠান তাদের লেনদেনের তথ্য, মোবাইল পেমেন্ট ইতিহাস, বিক্রয় এবং কর তথ্য বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রেডিট স্কোর তৈরি করবে। স্কোর ভালো হলে কয়েক ঘণ্টা বা সর্বোচ্চ দুই-তিন দিনের মধ্যে অনুমোদন দিতে হবে।
ঋণ অনুমোদন নির্ভর করবে স্বয়ংক্রিয় ও তথ্যনির্ভর ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে। ক্রেডিট স্কোরিং মডেল লেনদেনের পরিমাণ, বিক্রি, আয়, কর তথ্য ও পেমেন্ট ইতিহাস দেখে ক্রেডিট সীমা ও সুদের হার নির্ধারণ করবে। কার্ড ইস্যু করবে ব্যাংক বা ফিনটেক প্রতিষ্ঠান। তবে প্রাথমিকভাবে সরকার এসএমই ফান্ড বা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় কিছু ভর্তুকি বা গ্যারান্টি দিতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি কমবে এবং সহজে ঋণ দিতে উৎসাহিত হবে। সেই সাথে বীমা কোম্পানির সহায়তায় ইন্সুরেন্স সুবিধা সংযুক্ত করতে হবে।
কার্ডের ব্যবহার মূলত চলমান ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ফাইন্যান্স হিসেবে কাজ করবে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনে টাকা তুলতে ও ফেরত দিতে পারবে, যেমনটি ক্রেডিট কার্ডে হয়। পেমেন্ট শর্ত ১২ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত কিস্তিতে দেওয়া যেতে পারে, তবে মূল লক্ষ্য হবে বারংবার ব্যবহার করা যাবে এমন কার্যকরী মূলধন সুবিধা তৈরি করা।
ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন হবে ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি, লেনদেন নজরদারি, অ্যালার্ট সিস্টেম ও জালিয়াতি সনাক্তকরণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। সরকার চাইলে বড় ক্ষতির একটি অংশ পর্যন্ত গ্যারান্টি দিতে পারে, যাতে ব্যাংকগুলো নিরাপদ বোধ করে। পাশাপাশি গ্রাহক সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা জরুরি, যেন তারা ঋণটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শেখে।
প্রযুক্তিগতভাবে এই কার্ড পরিচালিত হবে একটি নিরাপদ এপিআই-ভিত্তিক ব্যবস্থায়, যেখানে ব্যাংক, এমএফএস, টেলিকম ও সরকারি ডেটাবেস (যেমন জাতীয় পরিচয় পত্র ও ট্যাক্স তথ্য) সংযুক্ত থাকবে। সব লেনদেন হবে এনক্রিপ্টেড ও ব্যবহারকারীর সম্মতি সাপেক্ষে।
এই সমন্বিত উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকবে যার যার দায়-দায়িত্ব অনুসারে। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা দেখবে, এসএমই ফাউন্ডেশন উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ দেবে, ব্যাংক/ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্ড ইস্যু করবে, আর এমএফএস প্রতিষ্ঠান অনবোর্ডিং ও লেনদেনের তথ্য সরবরাহ করবে।
প্রথমে ছয় থেকে নয় মাসের একটি পাইলট প্রকল্প চালু করা যেতে পারে তিনটি বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। যেখানে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ উদ্যোক্তা এই কার্ড ব্যবহার করবে। পাইলট শেষে তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে মডেলটি উন্নত করা হবে।
মূল্যায়নের জন্য দেখা হবে কতজন উদ্যোক্তা কার্ড পেয়েছে, অনুমোদন পেতে কত সময় লেগেছে, ঋণ আদায় না হবার হার কত এবং ডিজিটাল লেনদেন কতটা বেড়েছে। একই সঙ্গে নারী উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও ব্যবসার উন্নতির মতো সামাজিক প্রভাবও পরিমাপ করা হবে।
সবশেষে, এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে এটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য দ্রুত অর্থায়নের নতুন যুগ শুরু করতে পারে। বাংলাদেশের বিপুল অনানুষ্ঠানিক খাত তখন আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতায় আসবে, ব্যাংকের ঝুঁকি কমবে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে দেশের কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা উভয়ই বাড়বে।

Comments are closed.