কুল বাগানে ১৫ হাজার মানুষের জীবিকা
সাতক্ষীরায় বানিজ্যিকভাবে কুল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। অল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে ফলটির আবাদ। বর্তমানে এই জেলায় উৎপাদিত কুল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হচ্ছে।
এদিকে কুল চাষের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন পাঁচ হাজার পরিবারের ১৫ হাজারের বেশি নারী ও পুরুষ। তারা এসব কুল বাগানে শ্রমিকের কাজ করে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি হিসেবে পান।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, অন্য বছরের তুলনায় চলতি বছর কুলের ফলন ভালো হয়েছে জেলায়। এছাড়াও বাজার দর বেশি থাকায় লাভবান হচ্চেন চাষিরা। কৃষকদের সবভাবে পরামর্শ ও সহযোগীতা করে সাহাজ্য করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আরও জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এ জেলায় চলতি বছর ৭৯৫ হেক্টর জমিতে কুল চাষ হয়েছে। তবে কলারোয়া, তালা, সাতক্ষীরা সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি কুল চাষ হয়েছে। গত বছর জেলায় ৬৫০ হেক্টর জমিতে কুল চাষ করা হয়েছিল। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ধান, পাট ও সবজির উৎপাদন কমে যাওয়ায় কলারোয়া উপজেলার সিঙ্গা, হুলহুলিয়া, বহুড়া ও সাতপোতা এলাকায় ১৯৯৫ সাল থেকে বাণ্যিজিক ভিত্তিতে নারিকেল কুল, বাউকুল, আপেল কুল, বলসুন্দরী ও টক মিষ্টি কুল চাষ শুরু হয়।
এসবের কুলের মধ্যে আপেল, বল সুন্দরি, বাও, ও নারকেল কুল সুস্বাদু ও বাজারে বেশি দামে বিক্রি হয়। কুল বিক্রি করে কৃষকরা অধিক লাভ পাওয়ায় বর্তমানে জেলার বিভিন্ন উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রামে এ ফল চাষ শুরু হয়েছে।
কুল চাষিরা জানান, বাংলা বছরের ফাল্গুন মাসের শেষের দিক থেকে পুরাতন কুল গাছের ডাল কেটে ফেলে জমিতে সেচ ও পরিচর্যার কাজ শুরু হয়। কার্তিক মাসের প্রথম দিকে কুল গাছে ফুল ধরার পর বিভিন্ন কীটনাশক স্প্রে করা হয়। এ সময় কুল ফুলে মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটে। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিকে গাছে কুল ধরা শুরু হলে স্বাস্থ্য হানিকর নয় এমন হর্মোন স্প্রে করা হয়। পৌষ মাসের শুরুতেই কুল পাকতে শুরু করে। শেষ ফাল্গুন পর্যন্ত কুল পাওয়া যায়।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর আরও জানায়, বিঘা প্রতি মৌসুমে ৫০ থেকে ৫৫ কুইন্টাল কুল পাওয়া যায়। বর্তমানে নারিকেল কুল কেজি প্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা ও আপেল কুল ৬০ টাকা বল সুন্দরি কুল ৬০ থেকে ৭০ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। টক কুল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।
কলারোয়ার সিঙ্গা বাজার, তালার পাটকেলঘাটা শাহদহ ও সাতক্ষীরা শহরের বড় বাজারসহ কয়েকটি ডিপোর মাধ্যমে উৎপাদিত কুল জেলার চাহিদা মেটাচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিন প্রায় ১৫ মেট্রিক টন কুল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোরসহ ও দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। জেলায় প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার ও ১৫ হাজারের বেশি নারী ও পুরুষ শ্রমিক এসব কুল বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা এলাকার কুল চাষি মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার কুল বাগানে ১০ থেকে ১২ জন কাজ করেন। এক একজনের মাসিক বেতন ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা। এখানে কাজ করে যে টাকা শ্রমিকরা পান তা দিয়ে সন্তাদের পড়ালেখা ও সংসার ভালোভাবেই চালাতে পারেন তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারিভাবে যদি আর্থিক সহযোগীতা পেতাম তাহলে আরও বড় পরিসরে কুল চাষ করতে পারতাম।‘
অপর কুল বাগান মালিক মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘এবছর ১০ বিঘা জমিতে তিন রকম কুল চাষ করেছি। এখন পর্যন্ত ১৫-১৬ লাখ টাকা খরচ করেছি। আমার এখানে অনেকের কর্ম সংস্থান হয়েছে। সরকার আর্থিক সহযোগীতা করলে আরও বড় পরিসরে বাগান করতে পারতাম। এলাকার আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতাম তাহলে।’
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, সাতক্ষীরার বেলে দোঁয়াশ মাটি ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু কুল চাষের উপযোগী। ধান, পাট, সবজি ও মাছ চাষের তুলনায় এখনে কুল চাষে অধিক লাভবান হচ্চেন কৃষকরা। ফলে কুল চাষে ঝুঁকে পড়েছেন অনেক কৃষক। সাতক্ষীরার মাছের ঘেরের আইলেও কৃষকরা কুল চাষ করছেন। এবার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে কুল চাষ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরায় গত বছরের তুলনায় ১৩০ হেক্টও বা ২০ শতাংশ বেশি জমিতে কুল চাষ বেশি হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে কুল চাষ করতে খরচ হয়েছে কৃষকদের ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কুল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা মণ। আবহাওয়া ভালো থাকলে কুল চাষে বেশি লাভ হবে কৃষকদের।