কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি। এটি বলতেই আমরা বুঝি সিলেটের কথা। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো কুমিল্লার লালমাই পাহাড় থেকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি সংগ্রহ করা হচ্ছে। লালমাইয়ের লাল টিলাগুলোতে সবুজ পাতা মেলেছে চা গাছ। ইতোমধ্যে টিলাগুলোর চা বাগান উৎপাদনে যাওয়ায় চায়ের জেলা হিসেবে কুমিল্লা পরিচিতি পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
লালমাইয়ে চা বাগান আছে এ কথা প্রচার হওয়ার পর প্রতিদিনই নানা বয়সের উৎসুক মানুষ আসছেন বাগান ঘুরে দেখতে। উৎসুক জনতাকেও যেন হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছে লালমাই পাহাড়ের উচু-নিচু জমিতে জন্ম নেওয়া চা পাতার গাছগুলো। কুমিল্লার লালমাটি চা গাছের জন্য অনুকূল হলেও এখানে বৃষ্টি কম হওয়ায় কিছুটা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে মজুমদার চা বাগান কর্তৃপক্ষকে। যার কারণে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উঠিয়ে পাইপ দিয়ে গাছের গোড়ায় দিচ্ছেন শ্রমিকরা।
যেভাবে গড়ে উঠেছে চা বাগান: রোববার (৯ এপ্রিল) সকালে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা নগরীর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের বড় ধর্মপুর এলাকায় আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর ও ঢালুতে গড়ে উঠেছে মজুমদার চা বাগান। এই মজুমদার চা বাগানের মালিক হলেন মো. তারিকুল ইসলাম মজুমদার। ২০২১ সালে তিনি মৌলভীবাজারের এক চা বাগানের মালিক বন্ধুকে নিয়ে আসেন লালমাই পাহাড়ে। লালমাটি পরীক্ষা করে ও পাহাড়ের সার্বিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে ওই বন্ধু মতামত দেন এখানে চা বাগান গড়ে তোলা সম্ভব। বন্ধুর কথা শুনেই মজুমদার সাহেব নেমে পড়েন কাজে।
২ একর জমিতে ১২ হাজার চা গাছ: বন্ধুর মাধ্যমে তারিকুল ইসলাম মজুমদার শুরুতেই মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৮ নম্বর কালির ঘাট ইউনিয়নের বিলাশ চা বাগান এলাকার রাজু-দিপালী দম্পত্তিকে নিয়ে আসেন। মোট ২০ একর জমির মধ্যে তরিকুল মজুমদার শুরুতেই ২ একর জায়গার মধ্যে ৬ হাজার চাড়া রোপণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আরও ছয় হাজার চাড়া দিয়ে তার নিজ নামে মজুমদার চা বাগানের যাত্রা শুরু করেন।
চায়ের চাড়া যেভাবে সংগ্রহ করা হয়: মজুমদার চা বাগানের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক রাজু শিং জানান, পূর্নাঙ্গ চা গাছ থেকে কলপ নিয়ে বা গাছের গোড়ার দিকে ডাল দিয়ে কিছুটা প্রযুক্তি ব্যবহার করে চা গাছের চারা প্রস্তুত করা হয়। প্রথমে চারাটি ৯ ইঞ্চির মত পিন্ডি করা হয়। পরবর্তীতে দেড় থেকে আড়াই ফুট হলে বিক্রি করা হয়।
লালমাইয়ের বাগানে বিটি টু চা গাছ: চায়ের অনেক জাত থাকলেও কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের মজুমদার চা বাগানে লাগানো হয়েছে বিটি টু চা গাছ। এটি খুব উন্নত মানের চা। বিটি টু চা গাছের চারা সংগ্রহ করা হয় শ্রীমঙ্গল থেকে। প্রতিটি চাড়ার দাম হয় ৪৫ টাকা করে।
কুমিল্লার আবহাওয়া চা চাষে কতটুকু উপযোগী: কুমিল্লা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের লালমাটি সত্যিই চা চাষের জন্য উপযোগী। অপরদিকে, চা শ্রমিক দিপালী শিং ও রাজু শিং বলেন, আমরা বংশ পরম্পরায় চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কর্মরত আছি। আমরা মাটি দেখলেই বলে দিতে পারি এটা কতটুকু ভালো বা খারাপ। লালমাই পাহাড়ের মাটি খুবই উর্বর এবং চা চাষের জন্য উপযোগী। কিন্তু চায়ের ভালো উৎপাদন পেতে হলে বৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। যেখানে প্রচুর বৃষ্টি হয় সেখানে চায়ের উৎপাদন ভালো হয়। কুমিল্লায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হয় তা মোট চাষের জন্য শতকরা ১০ ভাগ মাত্র।
বৃষ্টির বিকল্প হিসেবে আমরা গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করি। পরে সেই পানি পাইপের সাহায্যে চা গাছের গোড়ায় দিচ্ছি।
চা গাছের নিরাপত্তা গাছ: উপস্থিত চা শ্রমিকরা জানান, ছোট থেকে তিন বছর পর্যন্ত চা গাছকে নিরাপদ রাখার জন্য চা গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো হয় শজনি ও কড়ই গাছ। এই দুটি গাছ চা গাছকে ছায়াসহ বিভিন্ন উপকার করে। চা গাছ যখন উৎপাদনে যায় তখন এই দুটি গাছের ডাল ছেটে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন ছত্রাক চা গাছকে আক্রমণ করে: উলুসহ নানা ছত্রাক বিভিন্ন সময় চা গাছকে আক্রমণ করে। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাই চা শ্রমিকদের সব সময় এই ছত্রাক সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়।
আপাতত কুমিল্লাবাসী পাচ্ছে গ্রিন টি: কুমিল্লার লালমাই মজুমদার চা বাগানের উৎপাদিত চা আপাতত সাধারণ চা হিসেবে খাওয়ার সুযোগ নেই। এটা খেতে হবে গ্রিন টি হিসেবে। কারণ হিসেবে বাগানের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক বলেন, সাধারণ চা হিসেবে খাওয়ার জন্য যে পাতা প্রস্তুত করতে হয় এই মেশিন এখনো আমরা আনতে পারিনি। আমাদের বস জানিয়েছেন, খুব দ্রুতই জাপান থেকে সেই উন্নত মানের মেশিন নিয়ে আসবেন। ওই মেশিন আসার আগ পর্যন্ত লালমাই পাহাড়ের এই চা গ্রিন টি হিসেবেই খেতে হবে।
সাত কর্মচারী দিয়ে চলছে চা বাগান : লালমাই মজুমদার চা বাগানে বর্তমানে দুইজন স্থায়ী ও ৫ জন অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন। রাজু শিং ও দিপাতী শিং দম্পত্তি মাসিক মজুরি হিসেবে বেতন পান। আর সাথে থাকার ব্যবস্থা ফ্রি। অপরদিকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ৫ জন নারী সাপ্তাহিক মজুরি হিসেবে কাজ করেন।
চা বাগানের মালিক যা বললেন: লালমাই মজুমদার চা বাগানের মালিক তারিকুল ইসলাম মজুমদার জানান, আমার বন্ধু জিডি সানের উৎসাহে আমি লালমাই পাহাড়ে চা বাগান করার ভরসা পাই। আমার পুরো জায়গায়ই আমি চা বাগান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যত দ্রুত সম্ভব চা পাতা প্রস্তুতের মেশিনও বাইরে থেকে নিয়ে আসা হবে।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা যা বললেন: কুমিল্লা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, চা বাগান কিন্তু কৃষি বিভাগের আওতায় পড়ে না। এটা চা বোর্ডের কাজ। তারপরেও তরিকুল মজুমদার আমাদের কাছে যখন যে সহযোগিতা চেয়েছেন আমরা একাধিকবার বাগানে গিয়ে সেই সহযোগিতা করেছি।
অন্যরা যদি লালমাই পাহাড়ে চা চাষ করতে চান তাহলে আমরা কৃষি জমি ঠিক রেখে সার্বিক সহযোগিতা করবো। লালমাই পাহাড় ছাড়া কুমিল্লার আর কোথায়ও চা উৎপাদনের কোন সম্ভাবনা নেই।
বাগানে বেড়াতে আসা ব্যক্তিরা যা বললেন: রোববার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রায় ১৫/২০ জন তরুণ তরুণী আসেন চা বাগান দেখতে। তাদেরই একজন আমিরুল ইসলাম সেলিম। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষার্থী তিনি। তিনি বলেন, আমাদের কুমিল্লার মানুষ শুধু চা বাগান দেখতে প্রতিবছর সিলেট কিংবা শ্রীমঙ্গল যায়। অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়। বাড়ির কাছে যদি চা বাগান থাকে তাহলে দূরে যাওয়ার দরকার হবে না।
বড় ধর্মপুর হয়ে উঠবে প্রাণচাঞ্চল্য: লালমাই পাহাড়ের এই মজুমদার চা বাগানকে কেন্দ্র করে অল্প দিনের মধ্যেই বড় ধর্মপুর এলাকাটি হয়ে উঠবে অসংখ্য দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখরিত। এলাকায় দেখা দিবে প্রাণচাঞ্চল্য। শক্তিশালী হয়ে উঠবে এলাকার আর্থ সামাজিক অবস্থান। কারণ, এখানে মানুষ যত আসবে ততই দোকানপাট ততো বাড়বে। আর্থিক লেনদেনও সৃষ্টি হবে। এভাবেই একদিন এলাকাটি হয়ে উঠবে বেকারত্বমুক্ত জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।