কারাগারের দেয়াল ভেদ করে বহু বছর পর এলো আজানের সুর, অস্ত্র হাতে এলেন মুক্তির দূত

সিরিয়ার কুখ্যাত সেদনায়া কারাগারে প্রায় ছয় বছর বন্দি থাকা ভুক্তভোগী আম্মার দুঘমুশ বার্তা সংস্থা আনাদোলুর কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে তার নির্যাতনের স্মৃতি এবং মুক্তি পাওয়ার রাতের স্মৃতি তুলে ধরেছেন। আনাদোলুকে তিনি জানিয়েছেন, কীভাবে তিনি বছরের পর বছর নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং কীভাবে গত বছর শাসকবিরোধী বাহিনী কারাগারটি ভেঙে ফেললে তিনি মুক্তির স্বাদ পান।

দুঘমুশ, দামেস্কের বাসিন্দা, হাজারো বন্দির মতোই বছরের পর বছর সুসংগঠিত নির্যাতন, ক্ষুধা, রোগ আর মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। কারাগারটি ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বাসার আল-আসাদ শাসনের সবচেয়ে ভয়ংকর দমনযন্ত্রের একটি।

২০১৮ সালে পূর্ব ঘৌতায় এক অতর্কিত হামলায় গ্রেপ্তার হন দুঘমুশ। প্রথমে তাকে মেজ্জেহ সামরিক বিমানঘাঁটির গোয়েন্দা শাখায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে সশস্ত্র থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, মারধর করা হয় এবং জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিতেও সই করানো হয়। তিনি বলেন, ‘ওরা আমার হাত পেছনে বেঁধে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল। মনে হচ্ছিল কাঁধ খুলে যাবে। এরপর জয়েন্টগুলোতে লাঠি দিয়ে মারত।’

 

পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় সেদনায়া কারাগারে, যেটিকে “মানব কসাইখানা” বলে অভিহিত করা হয়। দুঘমুশ স্মরণ করেন, তাকে ১৪৫ জন অন্য বন্দির সঙ্গে মাংস পরিবহনের রেফ্রিজারেশন ট্রাকে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রবেশের মুহূর্তেই নির্মম প্রহারের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বলেন, ‘যে মুহূর্ত থেকে আমি ওই জায়গায় প্রবেশ করলাম, আমার জীবন সম্পূর্ণ বিপর্যয়ে পরিণত হলো।’

যে সেলটিতে তাকে রাখা হয়, সেটির আকার ছিল প্রায় ৮ বাই ১৬ ফুট। সেটি ৬০ জনের জন্য তৈরি হলেও রাখা হতো ১২০ জনকে। দুঘমুশ বলেন, ‘আমরা একে অপরের ওপর গাদাগাদি করে ঘুমাতাম। সকালে দেখা যেত, কেউ কেউ শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেছে।’

আম্মার দুঘমুশ।

কারাগারের একমাত্র ফ্যানটি বন্ধ করে আরেক ধরনের শাস্তি দেয়া হতো বলে উল্লেখ করেন তিনি। দুঘমুশ বলেন, ‘সেলটা ভূগর্ভস্থ ছিল। কয়েক মিনিটেই অক্সিজেন ফুরিয়ে যেত। আমরা শ্বাস নিতে পারতাম না। রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহভাবে। বন্দিদের হ্যালুসিনেশন হতো, প্রস্রাব ধরে রাখতে পারত না এবং তিন দিনের মধ্যেই কেউ কেউ মারা যেত। কোনো ওষুধও ছিল না সেখানে।’

সেদনায়ার ‘ওয়েলকাম ফেজ’ ও নরক যন্ত্রণা
দুঘমুশ উল্লেখ করেন, সেদনায়ায় প্রবেশের পর বন্দিদের উলঙ্গ করে মাটিতে শোয়ানো হতো, এরপর শুরু হতো অমানবিক নির্যাতন-মারধর। ওয়েলকাম ফেজ বা স্বাগতম পর্ব ছিল ভয়াবহ। তাকে ও অন্যদের বারবার মারধর, অপমান এবং মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হতো।

তিনি “ব্যান্ড” নামে পরিচিত একটি নির্যাতন পদ্ধতিরও বর্ণনা দেন। জানান, বন্দিদের মেঝেতে শুইয়ে দাঁড়ানো পাহারাদাররা সারিবদ্ধভাবে তাদের পায়ের দিকে অবিরাম লাঠি দিয়ে মারত। তিনি স্মরণ করেন “আবু ইয়াকুব” নামে এক রক্ষীর কথাও, যিনি বয়স্ক বন্দিদের নিশানা করত। আবু ইয়াকুব চিৎকার করে বলতেন, ‘তোমরা যদি তোমাদের সন্তানদের ঠিকমতো মানুষ করতে, দেশ আজ এমন হতো না।’ দুঘমুশ জানান, এরপর সেসব বন্দিদের মারধর করতেন তিনি।

সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেদনায়ার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। চিকিৎসা রেফারেল বন্ধ হয়ে যায়, আর কারাগারের ভেতরের চিকিৎসকরা কেবল সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন বলে জানান তিনি।

মুক্তির রাতে ‘অল্লাহু আকবার’ ধ্বনি ও ভোরের আলো
২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতটি দুঘমুশের জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। রাত ১১টার দিকে তিনি সাইরেন শুনতে পান। এরপর নেমে আসে নিস্তব্ধতা, তারপর নারীদের ও শিশুদের কণ্ঠ, যা এর আগে কারাগারটিতে কখনও শোনা যায়নি।

সেদনায়া কারাগার।

সেদনায়া কারাগার।

রাত ৩টার দিকে কারো কণ্ঠ ভেসে আসে- “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি। এরপর গুলির শব্দ। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম এটি প্রহরীদের কোনো পাতানো ফাঁদ। পরে একজন বন্দি একটি ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, সে লম্বা দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে দেখেছে, যার হাতে রয়েছে অস্ত্র।’ তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী যোদ্ধা যিনি তাদের মুক্ত করতে এসেছিলেন। এরপর কেউ জোরে আজাদ দেন।

দুঘমুশ উল্লেখ করেন, এর মাধ্যমে কয়েক বছর পর আজান শুনেছিলাম আমরা। এরপর আমরা দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লাম। মনে হচ্ছিল আমাদের শিকল ভেঙে গেছে।’ তিনি বলতে থাকেন, ‘কিছুক্ষণ পরেই, বিদ্রোহীরা কারাগারের দরজা খুলে দেয়। যখন রুমের দরজা খুলে গেল, তখন আমাদের কোনো ধারণা ছিল না কোথায় যেতে হবে। আমরা কেবল একটি জিনিস জানতাম, শিকল ভেঙে গেছে, আমরা মুক্ত।’

দুঘমুশ বাইরে বেরিয়ে একটি লাঠি কুড়িয়ে নেন। তিনি বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছি জানতাম না, তবে আত্মরক্ষার জন্য কিছু চাইছিলাম। বাইরের লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’ তারা বলল, শাসনের পতন হয়েছে। প্রিজনের বাইরে ছিল হাজারো মানুষের ঢল। একজন বন্দি বেরোলেই মনে হচ্ছিল লাখো মানুষ ঢুকছে। সবার হাতেই ছিল প্রিয়জনের ছবি। রাস্তার পিচ দেখেই আমার জন্য আশ্চর্য ছিল। দুই দিন কিছু খাইনি। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এটা সত্যি।’

অবশেষে মেয়ের সাথে পুনর্মিলন: ‘এটাই স্বাধীনতা’
মুক্তির পর দুঘমুশ তার মেয়ের সঙ্গে পুনর্মিলনের মুহূর্তকে জীবনের স্বাধীনতা হিসেবে বর্ণনা করেন। বলেন, ‘যখন আমি তাকে আমার দিকে ছুটে আসতে দেখলাম, তখন আমার হাঁটু কেঁপে উঠল। আমরা ১৫ মিনিট ধরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। এত অপমান, রোগ, মারধর—সবকিছুর পর আল্লাহ আমাকে আবার মেয়েকে ধরার সুযোগ দিয়েছেন। সেটাই আমার জন্য স্বাধীনতার মুহূর্ত।’

You might also like

Comments are closed.