কাজুবাদামের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বেড়েছে
কারবারি লিয়ান আংয়ের বাড়ি বান্দরবানের রুমা উপজেলার মুনলাই পাড়ায়। ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ের ঢালে কাজুবাদামের গাছ দেখে দেখে বড় হয়েছেন। ফল ধরলেও বিক্রির সুযোগ ছিল না। ফলে কিছু কাজুবাদামের গাছ তিনি কেটেও ফেলেছিলেন। সময়ের ব্যবধানে এখন সেই কাজুবাদাম চাষেই বেশি আগ্রহ তাঁর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের সহায়তায় তিনি এবার পাহাড়ের ঢালে ৫০০টি কাজুবাদামের চারা লাগিয়েছেন। বিনামূল্যে চারা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তাও পেয়েছেন তিনি। সব ধরনের সহায়তা পেয়ে আশপাশের কয়েকশ চাষি এখন ঝুঁকেছেন কাজুবাদাম চাষে। তাতে পাহাড়ে তৈরি হয়েছে কাজুবাদামের নতুন সম্ভাবনা। কাজুবাদাম ঘিরে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন উদ্যোক্তারাও। এতে অপ্রচলিত কৃষিপণ্যটি দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও দেখাচ্ছে।
নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা :শূন্য থেকেই শুরু করেছে বাংলাদেশ। গত ৬ থেকে ৭ বছরে কাজুবাদামের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এ জন্য স্থানীয় প্রক্রিয়াজাত কারখানার সক্ষমতা বাড়ানো এবং নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি কাজুবাদামের স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছে সরকার। এ জন্য গত বছর নেওয়া হয় ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’। ১৯ জেলার ৬৬টি উপজেলায় ২০২৫ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের কার্যক্রম চলবে। কাজুবাদামের ওপর দুই হাজার ২৫০টি প্রদর্শনী, ৪৯ হাজার ৫০০ কৃষককে প্রশিক্ষণ, উচ্চ ফলনশীল নতুন দুটি জাত উদ্ভাবন এবং ২৫ হাজার জার্মপ্লাজম সংগ্রহসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে প্রকল্পের আওতায়। সরকারের এ উদ্যোগের ফলে কাজুবাদামে অর্থনীতির নতুন দুয়ার উন্মোচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ব্যাপকভাবে কাজুবাদামের চাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে প্রায় দুই হাজারের বেশি মানুষ এর বাগান করেছেন। বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার কৃষক রেনিং ম্রো ৫ একর জমিতে কাজুর আবাদ করেছেন। সেখানে গাছ রয়েছে মোট ৩ হাজার। সব গাছই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে দেওয়া। এই গাছ থেকে গত বছর ৯০ মণ টাম বিচি বিক্রি করেছেন। প্রতি মণ টাম বিচি (কাজুর গাছে উৎপাদিত ফল) ২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানান তিনি।
বান্দরবান সদর উপজেলার সাংগ্রাই ত্রিপুরা পাড়ার কাজুবাদাম চাষি জনরাই ত্রিপুরা জানান, তাঁর জমিতে দেশীয় কাজুবাদামের গাছ ছিল বেশ কয়েকটি। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বান্দরবান কৃষি অফিস থেকে ৭০৫টি এম-২৩ প্রজাতির চারা পেয়ে রোপণ করেন তিনি। চারা লাগানোর ১০ মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি গাছে তুলনামূলক বেশি ফলন পেয়েছেন। তাই দেশীয় গাছগুলো কেটে সেখানে নতুন করে এম-২৩ প্রজাতির কাজুবাদামের চারা রোপণ করছেন।
বান্দরবান সুয়ালক লম্বারাস্তা এলাকার এএল এগ্রো লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার সেলিম অগ্নি জানান, ২০২১ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে এম-২৩ প্রজাতির চারা উৎপাদন শুরু করেন তিনি। মোট ৩ লাখ চারা উৎপাদন করে বিক্রি করেন। চলতি বছর একই প্রজাতির উন্নতমানের বীজ থেকে সাড়ে তিন লাখ চারা উৎপাদন করেছেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় নার্সারি মালিক ও চাষিরা পাইকারি দরে এ চারা নিয়ে যাচ্ছেন। এ মৌসুমে প্রায় দেড় লাখের বেশি চারা বিক্রি হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়, কাজুবাদামের প্রক্রিয়াজাত কারখানা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা কাজুবাদামের বাগান থেকে প্রায় দেড় হাজার টন ‘টাম বিচি’ উৎপাদন হচ্ছে। স্থানীয় উৎপাদন কম থাকায় প্রাথমিক অবস্থায় ব্যাপকহারে কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি করে এনে প্রসেসিং বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ফের রপ্তানি করা হচ্ছে। দেশে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে বছরে ২৬০ থেকে ৩২০ টন কাজুবাদাম পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রায় ৭০০ টন প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি হচ্ছে। ২০১৮ সালে দেশে কাজুবাদামের ফল উৎপাদন হয় ৯১৬ টন। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৩২৩ টনে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও কাজুবাদামের বিশাল চাহিদা রয়েছে। আমরা যেসব পণ্য রপ্তানি করি, তার তুলনায় কাজুবাদামের দামও বেশি। সেজন্য আমরা কাজুবাদাম উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিচ্ছি।’
কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আগামী কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অর্থনীতিতে কাজুবাদামের বিপ্লব ঘটবে। প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে যে ধরনের সুবিধা দেওয়া দরকার, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাদের সমস্যা দূর করার চেষ্টা চলছে। কারণ আমাদের সর্বশেষ লক্ষ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন।’
বাড়ছে উদ্যোক্তা :কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, দেশে কাজুবাদামের ১৬টি প্রক্রিয়াজাত কারখানা রয়েছে। ২০১৬ সালে দেশে প্রথম চট্টগ্রামে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত শুরু করেন উদ্যোক্তা শাকিল আহমদ। তাঁর দেখাদেখি নতুন স্বপ্নের পথে হাঁটছেন অনেকে। ফলে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলেন, দেশে দ্রুত এর চাহিদা বাড়ছে। আবার রপ্তানির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। বিশ্বব্যাপী কাজুবাদামের চাহিদা বছরে বাড়ছে সাড়ে চার শতাংশ হারে। সেখানে বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
‘কৃষাণ ঘর এগ্রো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল ইসলাম জানান, রপ্তানিযোগ্য পণ্য হওয়ায় দেশে কাজুবাদাম চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি হয়ে যাওয়ায় দেশীয় কারখানা মার খাচ্ছে। অপরদিকে বেশি দামে বিদেশ থেকে কাজুবাদাম আমদানি করতে হচ্ছে।
নীলফামারীর মো. ইবনুল আরিফুজ্জামান জ্যাকপট ক্যাশিওনাট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি এ খাতে বিনিয়োগ করেছেন এক কোটি টাকার মতো। মাসে প্রায় সাত টন প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম উৎপাদন করছেন তিনি। এ উদ্যোক্তা বলেন, দেশি কাজুবাদামের আকার ছোট হওয়ায় বিশ্ববাজারে এর চাহিদা কম। আমদানি শুল্ক্ক ৫ শতাংশ করা হলেও বর্তমানে কাঁচা কাজুবাদাম আনতে নানা ধরনের কর ও ভ্যাট দিয়ে মোট মূল্যের ৩৭.৫ শতাংশ খরচ করতে হয়। এ খরচে কাঁচামাল এনে বাজারজাত করা পর্যন্ত যে খরচ হয় তার চেয়ে যাঁরা প্রক্রিয়াজাত করা কাজুবাদাম আমদানি করেন তাঁদের খরচ কম পড়ছে। শুল্ক্ক প্রত্যাহার ও ব্যাংক ঋণে জটিলতা দূর করার দাবি তাঁর।
বড় হচ্ছে বাজার :বাংলাদেশেও কাজুবাদামের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৩০০ কোটি টাকার কাজুবাদামের বাজার রয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে দেশে মাত্র ১৮ হাজার কেজি প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি হয়, যা ২০১৮-১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮০ হাজার টনে। ২০১৯-২০ সালে কাজুবাদাম আমদানি হয় সাড়ে ৬ লাখ টন। একই সঙ্গে বাড়ছে কাঁচা কাজুবাদাম আমদানিও। উদ্যোক্তারা খোসাসহ কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি করে প্রক্রিয়াজাত করছেন। এভাবেও রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৪ টন, ২০২১ সালে ২ হাজার ৩০ টন এবং এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১ হাজার ১১০ টন কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি হয়।