করোনা পুরো বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে: বান কি মুন
করোনাভাইরাস মহামারী মানবজাতির জন্য এক নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ। গত কয়েক দশকেও এমন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়নি বিশ্ব। বিশ্ব এবং এর নেতাদের জন্যও এটা একটা বড় পরীক্ষা।
এ মহামারী ইতিমধ্যে দুঃখজনকভাবে বিশাল সংখ্যক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে এবং একটা দীর্ঘমেয়াদি ও অকল্পনীয় আর্থিক মন্দা সৃষ্টি করবে।
ঐতিহাসিক এ হুমকি মোকাবেলায় বিশ্বনেতাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কোনো কালক্ষেপণ না করে তাদের সংকীর্ণ মনোভাব ও একপেশে জাতীয়তাবাদ দূরে ছুড়ে ফেলতে হবে। ক্ষুদ্র স্বার্থ, স্বল্পমেয়াদি ও আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা থেকে বের হয়ে সমগ্র মানবতার অভিন্ন স্বার্থ রক্ষার জন্য একযোগে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
আমি দীর্ঘদিন জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সংস্থার সাবেক প্রধান হিসেবে আমি জানি, কিভাবে এ করোনা মহামারীর মতো বৈশ্বিক সংকট আমাদেরকে/পুরো বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।
জাতিসংঘের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা হিসেবেই আমি আমার উত্তরসূরি মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেসের একটি মানবিক উদ্যোগের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছি। মহামারী মোকাবেলায় অতিরিক্ত ২০০ কোটি ডলার মানবিক ত্রাণ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন গুতেরেস।
আমার বিশ্বাস, এ সহায়তা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে টেস্টিং কিট তৈরি ও সরবরাহ, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশ্ব নেতাদের প্রতি আমার আরও একটি আবেদন, জাতিসংঘের নেতৃত্বে তারা যেন একটি বিশ্ব সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে এখনই চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। যাতে ভবিষ্যতে যে কোনো মহামারী বা দুর্যোগ আগেভাগেই আরও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
আমাদের সবাইকে জাতিসংঘ সনদের শিক্ষা ও মূল্যবোধগুলো আরও একবার পর্যালোচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া সমাজ ও সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় জি-২০, ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড তথা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের মতো বহুমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে হবে।
এটা খুবই আশার ব্যাপার যে, জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর নেতারা করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় যে কোনো পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনীতি রক্ষায় ৫ লাখ কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এ প্রতিশ্রুতিগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।
আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে হবে। যতদিন না অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের পাশে থাকতে হবে।
ইরানের মতো যেসব দেশ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে রয়েছে, সেসব দেশে জীবনরক্ষাকারী মেডিকেল সরঞ্জাম ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পরিবহনে বাধা তুলে নিতে হবে।
করোনার মতো অদৃশ্য এ দানবের বিপক্ষে ইতোমধ্যে মানবজাতি অনেকটাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এক দেশ অন্য দেশের বিপক্ষে অস্ত্র না পাঠিয়ে পাঠাচ্ছে চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ, চিকিৎসক এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস ও পাশে থাকার সান্ত্বনা। এ বিশ্বটাই যেন আমরা এতদিন শত-সহস্র সম্মেলন করেও পাচ্ছিলাম না।
দশকের পর দশক আমরা যুদ্ধ থামাতে পারিনি, থামাতে পারিনি জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ামক কার্বন নিঃসরণের মাত্রা। সিরিয়া, ইরাকের মতো ধ্বংস করেছি আমাদের বেঁচে থাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান ওজন স্তর, বরফ গলিয়ে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছি উপকূলীয় অঞ্চলের দেশগুলো।
অথচ কাউকে এখন আর সম্মেলন করে বা নিরাপত্তা পরিষদের অনুরোধ করতে হচ্ছে না। আমরা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছি যুদ্ধ, পরিবেশবিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র শিল্প। আমাদের পৈশাচিক প্রতিযোগিতা লকডাউন করে খুলে দিয়েছি মানবতার নির্মল আকাশ, শত্রুর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছি এক দানবের বিপক্ষে।
এরপরও কোভিড-১৯ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে গভীর বৈষম্যের মতো কিছু কঠিন বাস্তবতার ওপর তীর্যক আলো ফেলেছে। দেশে দেশে সম্পদের বৈষম্য আমাদের এ পৃথিবীটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ বৈষম্য দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার এটাই সেরা সময়।
★টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিবের নিবন্ধ।