সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক টেড্রস আধানম গেব্রিয়াসুস বলেছেন, বিশ্ব কভিড-১৯ মহামারি শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। অবিলম্বে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে করোনা। কয়েক দিন আগে দেশের একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনামে তাঁর বক্তব্য পড়ে আমার ভেতরটা আচমকা কেঁপে উঠেছিল। মোচড় দিয়ে ওঠে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারানো আমার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের শাখা-প্রশাখাগুলো। ভাবছিলাম, তাহলে বিশ্ববাসী পুনরায় উন্মুক্ত নীল আকাশে নিঃশঙ্কচিত্তে ঘুরে বেড়াবে? দেশে দেশে মাস্কবিহীন অবাধ বিচরণ শুরু হবে? দীর্ঘ নিরাপদ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় মানুষ কতকাল ধরে যেন মুখিয়ে আছে। চাই মানুষের সম্পূর্ণ মুখাবয়বের ফের উন্মোচন। সবাই কাছাকাছি থাক জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষে। আবার দশদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ুক মানুষের অন্তহীন মিছিল।
২. গত তিন বছরে বয়ে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ও অদৃশ্য করোনা-ঝড়ের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বিশ্ব মানচিত্রের চিরচেনা ছবি। পৃথিবীর অসংখ্য জনপদে নেমে আসে অন্ধকারের মতো বিভীষিকার দুঃস্বপ্ন। ভেঙে পড়ে বাজার অর্থনীতি, মুখ থুবড়ে পড়ে পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতি। আকস্মিক বিচ্ছিন্নতায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পরিবার ও সমাজ। হাঁচিকাশি এমনকি নিঃশ্বাস প্রশ্বাসেও মানুষের জীবন হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রিত। প্রিয়জনকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ, স্তম্ভিত হয়ে যায় মানুষ। অশ্রু শুকিয়ে শোকে কাতর ও পাথর হয়ে যায় নিকট স্বজনরা। আহা! কী নিঃসঙ্গতায়, কী অসহায় ও একাকিত্বের ভেতর দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে অগুনতি কীর্তিমানকে। অন্তিমকালে বাবা ছেলের মুখ দেখতে পায়নি, মা সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতে করতে পরপারে পাড়ি জমায়। জ্ঞাতিগোষ্ঠী ও আপনজন থাকা সত্ত্বেও বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকে হাসপাতালের আঙিনায়। দেখার কেউ নেই। কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে মৃতের সৎকারের দায়িত্ব পালন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম এবং একাধিক ধর্মীয় সংগঠন। চিকিৎসকরা দিশেহারা, ভীতসন্ত্রস্ত। কেউ কেউ চাকরির মায়াকে তুচ্ছজ্ঞান করে চার দেয়ালের ভেতরেই বাঁচতে চেয়েছেন। লকডাউনের গৃহবন্দিত্ব, দরজা-জানালায় তালা দেওয়া, পত্রিকাসহ বাইরের বস্তুর ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এমন কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার এ বেঁচে থাকা। অক্সিজেন আর পিপিইর নিরবচ্ছিন্ন সাপ্লাই নিয়ে তুলকালাম বেধে যায় রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র। টিকা আমদানি, টিকা প্রস্তুত, টিকার ট্রায়াল, টিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, টিকার রাজনীতি, টিকার অর্থনীতি কতকিছুই না ঘটে গেল স্বদেশে এবং বিশ্বব্যাপী। প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষের যুগে বা বিজ্ঞানের আকাশছোঁয়া জয়জয়ন্তীতেও মানুষ কীভাবে দিকজ্ঞ্বিকশূন্য হয়ে পড়ে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় তার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে থাকলাম কেবল আমরা এবং আমাদের সময়ের এ জীবিত প্রজন্ম।
৩. ২০২০ সালের শুরুতে এশিয়ার শক্তিধর দেশ চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুততম সময়ে গোটা পৃথিবীকে আক্রান্ত করে ফেলে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মানবসভ্যতা। এযাবৎ বাংলাদেশে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সারাবিশ্বে ৬৫ লাখ ৫০ হাজার। ভারত, চীন, ইতালি বা ব্রাজিলে লাশের মিছিলের চিত্র দু’চোখের আলোয় এখনও স্থির হয়ে আছে। নাগরিকের জীবন রক্ষার্থে পৃথিবীর অনেক দেশের উচ্চ আদালত সরকারের ওপর স্বতঃপ্রণোদিত নির্দেশনা জারি করেছেন। উৎপাদনকারী দেশগুলো নিজের দেশের চাহিদা মেটানোর আগে কোনো টিকা রপ্তানি করতে পারবে না। বিশ্ব ফুটবলের কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনাও করোনাভাইরাসের শিকার হয়ে পৃথিবী ছাড়েন। কী মর্মান্তিক মানবেতর ও করুণ দৃশ্য অবলোকন করেছে মানবসভ্যতা তা এ মুহূর্তে বর্ণনাতীত।
৪. করোনার প্রথম দিকে উন্নত দুনিয়ার চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও বিব্রত হয়ে হোঁটচ খাওয়ার সম্মুখীন হন। অপফোর্ডের বিশেষজ্ঞরা ক্রমাগত ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে আশার বাণী শুনিয়ে গেছেন। বাংলাদেশেও হিউম্যান ট্রায়ালের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল একাধিক বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি। মনে হচ্ছিল, পৃথিবী এই প্রথম এক এবং অভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে কভিড-১৯ ভাইরাসের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তবে যথাযথ প্রতিষেধক আবিস্কার করতে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই সাফল্য এনে দেয়। কেননা এ চাওয়া ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের এবং সর্বজনীন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্ব ও ভূমিকা ছিল অনন্য। সংস্থাটি বিশ্ববাসীর কাছে আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। নিজের দেশেও করোনার প্রতিষেধক টিকা তৈরির প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ সরকার। বেসরকারি উদ্যোগে ‘গ্লোব বায়োটেক’ নামের একটি দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি একের পর এক ট্রায়ালে অবতীর্ণ হয়। তারা বান-কোভিড নাম দিয়ে যাত্রা শুরু করলে এক পর্যায়ে নাম পরিবর্তন করে টিকার নাম বঙ্গভক্স রাখে। যার কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে। হয়তো অচিরেই শতভাগ সফলতা ধরা দেবে।
৫. আমাদের বাংলাদেশে করোনাকালে তথা কভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে যান অসংখ্য খ্যাতিমান মনীষী। এ তালিকাও একেবারে ছোটখাটো নয়। এদের বাঙালি জাতি কী খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারে? অবশ্যই না। আজ এখানে মাতৃভূমির কয়েকজন ইতিহাস সৃষ্টিকারীকে আরেকবার অশ্রুসজল হয়ে স্মরণ করতে পারি- জাতীয় অধ্যাপক সংবিধানের অনুবাদক ড. আনিসুজ্জামান এবং ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, খ্যাতিমান ডা. কর্নেল (অব.) মনিরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, ভাষাবিদ কামাল লোহানী, অধ্যাপক, লেখক ও শিল্পবোদ্ধা ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আসাদুজ্জামান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুক্তিযোদ্ধা ড. সাদত হোসাইন, সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক মন্ত্রী সাহারা খাতুন, শেখ মোহাম্মদ আবদুলল্গাহ, অধ্যাপিকা মমতাজ বেগম, আলহাজ মো. মকবুল হোসেন, প্রতিরক্ষা সচিব আবদুলল্গাহ আল মহসীন চৌধুরী, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের সহধর্মিণী কামরুন্নাহার জেবু, সংগীতশিল্পী ও সুরকার আজাদ রহমান, ফকির আলমগীর, এন্ড্রু কিশোর, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক, বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের, স্বনামধন্য অভিনেত্রী কবরী, অভিনেতা আবদুল কাদের, শিল্পপতি নূরুল ইসলাম বাবুল, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, টিভি ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দসহ আরও অনেক। যাদের নাম অজ্ঞাত এবং অজানা।
৬. আজকাল মাঝেমধ্যে আমি এক কল্পলোকের স্বপ্নের মধ্যে পড়ে থাকি। যাকে বলে ঘোরলাগা স্বপ্ন। তখন কল্পনার মহাবিশ্বে আমার অবাধ বিচরণ চলে। আমার ভাবনাবিলাসের যেন অন্ত নেই। মনে মনে বলি, করোনাভাইরাসের শিকার হয়ে চলে যাওয়া মানুষগুলো হয়তো আবার আমাদের পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এটা তাদের চিরবিদায় নয়। মহামারিতে মৃতরা নাকি নিষ্পাপ দেবতুল্য।
লেখকঃ হোসেন আবদুল মান্নান, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।