পাঁচ বছর আগে ২০২০ সালের মার্চে বিশ্বে আতঙ্কজনকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। সংক্রমণ রোধ ও মানুষের মৃত্যু কমানোর চেষ্টায় লকডাউনের মতো বিধিনিষেধে আটকা পড়ে অনেক দেশ। এতে ঘরবন্দী হয়ে পড়েন কোটি কোটি মানুষ।
মার্চে ঘরবন্দী হয়ে পড়া কোটি কোটি মানুষ বাড়িঘরের জানালা দিয়ে এমন এক পৃথিবী দেখতে শুরু করেন, যার সঙ্গে তারা পরিচিত ছিলেন না কখনো। আকস্মিক ‘ঘরবন্দী’ হয়ে তাদের জীবন আচমকাই চারদেয়াল ও কম্পিউটার স্ক্রিনে সংকুচিত হয়ে পড়ে।
ঢাকায় করোনায় নাগরিকদের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সরকার। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে জাতীয় নেতারা টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে লোকজনকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেন। শুধু জরুরি প্রয়োজনে বা দিনে একবার শরীরচর্চার জন্য বাইরে বের হতে বলেন। এসবই ছিল ভয়ানক গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকা ভাইরাসের সংক্রমণ আটকে রাখার চেষ্টা তাদের। তবে এরই মধ্যে দেশে দেশে মারা গেছেন হাজারো মানুষ।
তবে আতঙ্কের মধ্যেও কিছু দেশ লকডাউনের পথে হাঁটেনি। নাগরিকদের চলাচলে ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় আরোপ করেনি কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা।
ভারতের দিল্লিতে লকডাউনের চিত্র। সংগৃহীত
অবশ্য কিছু দেশ হাঁটে ভিন্নপথে। সুইডেন, তাইওয়ান, উরুগুয়ে, আইসল্যান্ড ও অল্প আরও কয়েকটি দেশ লকডাউনের মতো মানুষের জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপ কখনোই কার্যকর করেনি। এর বদলে দেশগুলো বেশি সংখ্যায় মানুষের একত্র হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, ব্যাপকভাবে করোনা পরীক্ষা, সংক্রমিত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে রাখা বা ভ্রমণে বিধিনিষেধের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
অবশ্য কিছু দেশ হাঁটে ভিন্নপথে। সুইডেন, তাইওয়ান, উরুগুয়ে, আইসল্যান্ড ও অল্প আরও কয়েকটি দেশ লকডাউনের মতো মানুষের জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপ কখনোই কার্যকর করেনি। এর বদলে দেশগুলো বেশি সংখ্যায় মানুষের একত্র হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, ব্যাপকভাবে করোনা পরীক্ষা, সংক্রমিত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে রাখা বা ভ্রমণে বিধিনিষেধের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পাঁচ বছর পর অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তের সন্নিবেশ ঘটেছে, হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি নানা মূল্যায়ন। তাতে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো না নিয়ে ওই সব দেশ ঠিক কাজ করেছে কি না, সে বিষয় উঠে এসেছে।
করোনায় নাগরিকদের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সুইডেন। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের অন্য দেশের মতো সুইডেনের প্রতিবেশী নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কও ২০২০ সালের মার্চে জাতীয়ভাবে লকডাউন ঘোষণা করে। কিন্তু নিজ দেশ সুইডেনের সরকার এমন পদক্ষেপে যায়নি, সেটি জানান ম্যাক ম্যানাস।
লকডাউনের কারণে কিছু দেশে লোকজন এমনকি তাদের পোষা কুকুর নিয়ে কীভাবে ঘরের বাইরে বের হতে পারেননি, তা–ও শুনেছেন ম্যাক ম্যানাস। দক্ষিণ আফ্রিকা এ রকম একটি দেশ। এটা ম্যাক ম্যানাসকে ব্যথিত করে। ওই সময় ব্লগে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমাদের দেশের সরকার একটা নিরাপদ ও সঠিক পন্থায় কাজ করছে বলে আমি মনে করি।’ তবে তার অনেক সহকর্মী জনস্বাস্থ্য–সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা, যেমন মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় না করা—সব সময় মেনে না চলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
করোনায় তার দেশ সুইডেনে ঠিক কত মানুষ মারা গেছেন, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে চান ম্যানাস। সেই সঙ্গে তার আছে এ প্রশ্নও, ‘লকডাউন হলে দেশে কি আরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচানো যেত?’
বিজ্ঞানীরা ম্যাক ম্যানাসের এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের ইংবর্গ ফরথুন ও সুইডেনসহ কয়েকটি দেশের গবেষকেরা ২০২৪ সালের মে মাসে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। সেখানে লকডাউনে না যাওয়া সুইডেন এবং কড়াকড়িভাবে লকডাউন আরোপ করা নরওয়ে, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডে মহামারির প্রথম কয়েক বছরে করোনায় মৃত্যুর ওপর তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এ চিত্রে দেখা গেছে, সুইডেন তার নাগরিকদের ওপর কড়াকড়িভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার বদলে প্রধানত স্বেচ্ছা আচরণ পরিবর্তনমূলক পদক্ষেপে জোর দিয়েছে। বিপরীতে উল্লিখিত অপর তিনটি দেশ করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে কঠোর লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এসব দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ জনজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থাকা অনেক কিছুই বন্ধ করে দেয়, অনুরোধ জানায় লোকজনকে ঘরে থেকে কাজ করতে। তবে এসব করেও লোকজনকে ঘরে আটকে রাখা যায়নি।
করোনায় নাগরিকদের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেনি সুইডেন। ছবি: সংগৃহীত
সুইডেন তার নাগরিকদের ওপর কড়াকড়িভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার বদলে প্রধানত স্বেচ্ছা আচরণ পরিবর্তনমূলক পদক্ষেপে জোর দিয়েছে। বিপরীতে অপর তিন দেশ করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে কঠোর লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এসব দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ জনজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থাকা অনেক কিছুই বন্ধ করে দেয়, অনুরোধ জানায় লোকজনকে ঘরে থেকে কাজ করতে। তবে এসব করেও লোকজনকে ঘরে আটকে রাখা যায়নি।
সম্ভবত আশ্চর্যজনক না হলেও গবেষকেরা দেখেছেন, ২০২০ সালের বসন্ত ও শীতে মহামারির প্রাথমিক ঢেউ চলার সময় সুইডেনে মৃত্যুর হার লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। ওই সময় কোভিড-১৯ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আরও অবাধে দেশটিতে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়। কিন্তু সে বছর অন্য তিনটি দেশে বাড়তি মৃত্যুহার কমে গেলেও ২০২১ ও ২০২২ সালে সুইডেনের তুলনায় বেড়েছে।
জনসংখ্যার আকার বিবেচনায় চার দেশেই মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি ছিল, বলেন ফরথুন। লকডাউন অংশত মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সময়কালকে প্রভাবিত করেছিল। উদাহরণ হিসেবে নরওয়ে সম্পর্কে ফরথুন বলেন, ‘আমরা সম্ভবত কিছু বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছি।’ যদিও ২০২০ সালে কেয়ার হোমে উচ্চ সংখ্যায় মৃত্যুর জন্য সুইডেনের কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে করোনাকালে বেকার হয়ে পড়া জনগোষ্ঠি তাকিয়ে ছিল সরকারি সহায়তার দিকে। ছবি: সংগৃহীত
কিছু অর্থনীতিবিদ করোনাকালে এই চার নর্ডিক দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সূচকের তুলনা করেছেন। তারা যুক্তি দিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে তুলনামূলক কম অর্থনৈতিক ব্যয়ের কারণে সুইডেনের পদ্ধতিটি ন্যায্য ছিল। কিন্তু এ ধরনের যুক্তি বিতর্কিত এবং সুইডেনে লকডাউন ঘোষণা না করা এখনো কারও কারও মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্কের বিষয় হয়ে রয়েছে।
নিল ব্রাসেলারস সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের একজন মহামারি বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজ দেশের গ্রহণ করা কোভিড-১৯ কৌশলের সমালোচনা করেন। মহামারি চলাকালে বেলজিয়ামে চলে যান তিনি।
নিল বলেন, ‘আমি একজন চিকিৎসক। তাই মানুষের জীবন রক্ষায় ব্যাপারে আমি অবশ্যই যত্নবান হব। আমরা প্রত্যেক মানুষের জীবন বাঁচাতে চাই।’