কবিগুরুর জন্মদিন: করোনাকাল এবং রবীন্দ্রনাথ

কৃষ্ণ কুমার শর্মা

আজ পঁচিশে বৈশাখ। বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী। ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি, কৌতূহলভরে…।’ জন্মের দেড়শো বছর পরেও তিনি প্রাসঙ্গিক। তার ভাবধারা আজও অক্ষুণ্ণ। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বর্তমানে দেশজুড়ে আতঙ্কের পরিস্থিতি। কোভিড-১৯ মহামারি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে লাখ লাখ মানুষের। তবে এই মহামারী মাঝেও তার লেখনী ভরসা জুগিয়েছে হাজার হাজার দেশবাসীকে। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, সাহিত্যে বার বার মহামারীর প্রসঙ্গ এসেছে। বড্ড বাস্তববাদী ছিলেন কবিগুরু। আর সেই কারণেই লিখেছিলেন, ‘…ম্যালেরিয়া-প্লেগ-দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষমাত্র, তাহারা বাহ্য লক্ষণ মাত্র। মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। আমরা এতদিন একভাবে চলিয়া আসিতেছিলাম আমাদের হাটে বাটে গ্রামে পল্লীতে একভাবে বাঁচিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম, আমাদের সে ব্যবস্থা বহুকালের পুরাতন। তাহার পরে বাহিরের সংঘাতে আমাদের অবস্থান্তর ঘটিয়াছে। এই নতুন অবস্থার সহিত আমরা এখনো সম্পূর্ন আপস করিয়া লইতে পারি নাই; এক জায়গায় মিলাইয়া লইতে গিয়া আর এক জায়গায় অঘটন ঘটিতেছে। যদি এই নতুনের সহিত আমরা কোনোদিন সামঞ্জস্য করিয়া লইতে না পারি তবে আমাদিগকে মরিতেই হইবে।’

অর্থাৎ আজ থেকে একশো বছর আগে নিউ নরম্যাল সূত্রে বাঁচার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তা না মানলে যে মৃত্যু মিছিল ঠেকানো সম্ভব না, সে কথাও বার বার বলেছেন তিনি।

আসলে নিজের চোখে প্লেগের ভয়াবহতা দেখেছেন। ম্যালেরিয়ায় আফ্রিকার গ্রাম কে গ্রাম উজার হয়ে যাওয়ার খবর শুনেছেন। কালাজ্বর, ডিপথেরিয়া, গুটি বসন্তের মতো রোগের বীভৎসতা দেখেছেন স্বচক্ষে। আর তাই তার লেখায় বার বার ফিরে এসেছে মহামারীর ভয়াবহতা। ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় বসন্ত রোগের মারণ দিক তুলে ধরেছেন। তেমনই ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে জগমোহনের মৃত্যুর বিবরণ দিয়ে বলেছেন, ‘…পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন, ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই।’ আজকের অবস্থাও অনেকটা একই রকম।

নিজের পরিবারেও তো বার বার মৃত্যু দেখেছেন। প্লেগ রোগেই মৃত্যু হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুকন্যার। মহামারীর বীভৎসতা তখন গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। তবে শোক আগলে বাঁচা যায় না। সে কথা জানতেন কবিগুরু। তাই লিখেছিলেন, ‘আশা ফুরাইলে, সব ফুরাইল।’

একদিকে তার লেখায় যেমন ফুটে উঠেছে মহামারীর রূঢ় চিত্র, তেমনই আশার আলো দেখিয়েছেন তিনিই। ‘পুরাতন ভৃত্য’তে-ও কিন্তু কেষ্টা আগলে রেখেছিল বাবুকে। জীবন দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির। আজ যেভাবে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা আগলে রাখছেন সাধারণ মানুষকে। অপেক্ষা করছেন সুদিনের, অপেক্ষা করছেন কোভিডমুক্ত পৃথিবীর।

মৃত্যু এবং মহামারী শেষে সুদিন যে আসবে, সে আভাসও দিয়েছেন রবি ঠাকুর। তাইতো তিনি লিখেছেন, আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন জাগে, তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে…।’

বিশ্বের দরবারে বাঙালিদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেও শিখিয়েছেন কবিগুরু। যার কারণে বাঙালির অস্তিত্বে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, সুরে ও বিচিত্র গানের বাণীতে, অসাধারণ সব দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধে, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতিসংলগ্ন গভীর জীবনবাদী চিন্তা জাগানিয়া লেখায় এমনকি চিত্রকলায়ও রবীন্দ্রনাথ চিরনবীন। প্রথম এশীয় হিসেবে ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।


লেখকঃ ফেলো মেম্বার, ইন্সটিটিউট অব চার্টাড সেক্রেটারী অব বাংলাদেশ।
ইমেইলঃ Krishnabd07@gmail.com

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.