চিকিৎসকরা চাইলেও সব করতে পারেন না, তৃতীয় পক্ষ হিসেবে থাকে হাসপাতাল

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের ওয়েবিনারে বক্তারা

দেশের প্রায় সব সেক্টরেই পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে সততা একট বড় ইস্যু। দেশের যে কোন নাগরিক যে কোন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ সেবা পাবেন, সংবিধান সেই অধিকার তাকে দিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী বা তার স্বজন সরাসরি আইনী প্রক্রিয়ায় যেতে চান না। আর তখনই তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অন্যদিকে গড়ায়।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক সময় চিকিৎসক যথাসময়ে উপস্থিত থাকেন না কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল বা চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত থাকেন। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানি চিকিৎসকদের নানান উপহার ও অন্যান্য সুবিধা দেয়ায় তারা রোগীকে ঔষধ লেখার আগেই দায়বদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ঔষধ লিখতে। চিকিৎসক-রোগীর মাঝে সম্পর্ক সেবামূলক হলেও চিকিৎসকরা সবসময় চাইলেও সবকিছু করতে পারেন না কারণ তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সেখানে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

রবিবার (০৭ মার্চ) রাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব মতামত ব্যক্ত করেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানের এ পর্বে আলোচনার মূল বিষয় ছিল- স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নে শিষ্টাচার, সুবিচার ও সাম্যের গুরুত্ব।

ওয়েবিনারে আলোচক অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কোষাধ্যক্ষ ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী, মানিকগঞ্জের শিবালয়ের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ড. আসিফ ইকবাল, আইনজীবী ও লেখক পারভীন আখতার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী লুবনা ইয়াসমিন।

আলোচনার শুরুতে ড. আসিফ বলেন, শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয়, দেশের প্রায় সব সেক্টরেই পেশাদারিত্বের ক্ষত্রে সততা একট বড় ইস্যু। নিজ নিজ পেশার প্রতি সততা এবং একাগ্রতা ঠিক রাখতে দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে যাতে খুব ছোটবেলা থেকেই মানুষ এসব শেখে। চিকিৎসকদের পাশাপাশি রোগীদের মধ্যেও অনেক সময় সহনশীলতার ঘাটতি দেখা যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রেও শিক্ষাই হতে পারে নিয়ামক। শিক্ষাই মানুষকে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে কখনোই গুরুত্ব দেয়া হয়না। গণমাধ্যম এবং অন্যান্য জায়গায় চিকিৎসক এবং রোগীকে একপ্রকার প্রতিপক্ষ রূপে দেখানো হয় যা কোনভাবেই ঠিক নয়। সব পেশাতেই এ জাতীয় সমস্যা রয়েছে। অনাস্থার জায়গা সব পেশাতেই আছে।

দেশের যে কোন নাগরিক যে কোন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ সেবা পাবেন, সংবিধান সেই অধিকার তাকে দিয়েছে উল্লেখ করে ব্যারিস্টার রাগীব বলেন, মেডিকেল নেগলিজেন্স এর বিষয়ে পেনাল কোডে সরাসরি কোন প্রোভিশন না থাকায় এসব নিয়ে সরাসরি আইনী প্রক্রিয়া দেখতে পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী বা তার স্বজন সরাসরি আইনী প্রক্রিয়ায় যেতে চান না। আর তখনই তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অন্যদিকে গড়ায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক সময় চিকিৎসক যথাসময়ে উপস্থিত থাকেন না কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল বা চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত থাকেন। এতে রোগীরা ওই চিকিৎসকদের প্রতি এক ধরনের বিরূপ মনোভাব নিয়েই হাসপাতালে যান। চিকিৎসকদের প্রতি তখন রোগীদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়। এছাড়াও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে নিজেদের পছন্দমতো কোম্পানির অতিরিক্ত ঔষধ লেখারও অভিযোগ আছে। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানি চিকিৎসকদের নানান উপহার ও সুবিধা দেয়ায় তারা রোগীকে ঔষধ লেখার আগেই দায়বদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ঔষধ লিখতে। এছাড়া বিভিন্ন প্যাথলজি ল্যাবে এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও অহেতুক রোগী পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। তাছাড়া অনেক বড় বড় হাসপাতালে ভালো বেতনে চিকিৎসক নিয়োগ দেয় হয় এই শর্তে যে তারা ওই হাসপাতালকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফার সুযোগ করে দেবেন। ফলে চিকিৎসক রোগী দেখে অহেতুক অনেক পরীক্ষা দেন, ভর্তি করান, কেবিন/আইসিউতে পাঠান যার মাধ্যমে হাসপাতালের অধিক মুনাফা হয়।

শুধু আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে এসব সমাধান করা সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসকদের সংগঠন সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে নিয়ে এজন্য একটি টাস্কফোর্স জাতীয় কিছু করে বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

এডভোকেট পারভীন সংক্ষুব্ধ রোগীর স্বজনদের দ্বারা অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা ঘটবার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার উপর জোর দেন। তিনি বলেন, চিকিৎসক এবং রোগী ছাড়াও তৃতীয় পক্ষ হিসেবে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসক-রোগীর মাঝে সম্পর্ক সেবামূলক হলেও চিকিৎসকরা সবসময় চাইলেও সবকিছু করতে পারেন না। এটাও মাথায় রাখতে হবে। অনেক হাসপাতালে নার্স পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হয়না, ক্লিনাররাই নার্স হিসেবে কাজ করেন। সরকারি হাসপাতালে কাগজেকলমে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার তালিকা দেখানো হলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো দেখতে পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, হাসপাতালগুলো চিকিৎসকদের দ্বারা পরিচালিত করার পাশাপাশি রোগীদের প্রতি ভালো আচরণ, পর্যাপ্ত সময় দিয়ে রোগী দেখা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে ঔষধ প্রাশাসন, ফার্মাসিউটিক্যালস এসোসিয়েশন সহ সকলকে যৌথ দায়িত্ব নিতে হবে। এছাড়া ব্যক্তিভিত্তিক চিকিৎসক না হয়ে রোগভিত্তিক চিকিৎসক অর্থাৎ সাধারণ চিকিৎসকের ধাপ পার হয়েই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পর্যন্ত যাওয়া উচিত যাতে রোগীদের সেবার মান যেমন নিশ্চিত হবে, পাশাপাশি অহেতুক বিড়ম্বনাও কমাবে।

অনুষ্ঠান শেষে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে আয়োজন করার জন্য আলোচকরা ধন্যবাদ জানান।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.