ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ ১০ মাস ধরে লড়াই করে সোমবার মারা গেছেন বাংলাদেশের অসম্ভব জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। এর মাঝে বেশ কয়েকবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। রবিবার হঠাৎ করে আবারো তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে তার স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রোর একটি হৃদয়বিদারক লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। লেখাটি হুবহু মাল্টিনিউজটোয়েন্টিফোর পাঠকদের জন্য দেয়া হলঃ
“অনেকেই ভাবছেন এটা আসল না নকল। আসল যারা ভেবেছেন তাদের জন্য শুভকামনা। প্রথম যে পোস্ট দুইটা দেয়া হয়েছে সেটা Andrew Kishor এর কথা।
আমি শুধু মাত্র লিখেছি। আমি কিশোরের বউ। এখন আমি কিছু বলবো।
গত বছর, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, আমরা সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। সেখানে কিশোরের ধরা পরে Diffuse Large B Cell Lymphoma (cancer in both Adrenal Gland) । তারপর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি শেষ হয় এপ্রিল মাসে। ডাক্তার বলেন এখন আর কোন কিছুর দরকার নাই। medicine দিয়ে বলেন আগস্ট মাসে আসতে। আমরা ১৩ মে দেশে আসার জন্য টিকেট কাটি, কিন্তু কিশোর ভয় পায়, কারণ সে শারীরিকভাবে খুব দুর্বল ছিল । আমি টিকেট বাতিল করি। ডাক্তার বলেন, এটা কেমোর জন্য, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, সময় লাগবে।
পরে ১০ জুন আবার টিকেট কাটি, কিন্তু হঠাৎ ২ জুন কিশোরের হালকা জ্বর আসে, ৩ জুন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করেন ডাক্তার। কিন্তু জ্বর বার বার আসতে থাকে। কোন medicine তার শরীরে কাজ করছিল না। হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন, PET SCAN করতে হবে, Lymphoma আবার back করেছে কিনা দেখতে হবে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে শুধু ঈশ্বর- কে ডেকেছি। কারণ শুরুতে ডাক্তার বলেছিলেন, Lymphoma যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি back করে , তাহলে সেটা double strong হয়ে আসে আর খুব দ্রুত ছড়ায় এবং সেটা কোনভাবেই control করা সম্ভব হয় না।
৯ জুন PET SCAN হয় এবং সেদিন রাতে ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন যে, পরদিন মানে ১০ জুন সকাল ১০ টায় আমার সাথে PET SCAN report নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চান । ৯ জুন রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি, সকালে ১০ টার আগে হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকি কিশোরের পাশে। কিশোর আমাকে বলল, ডাক্তারকে বলবা, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেশে ফিরবো। আমি ভয়ে চুপ করে বসে আছি, শুধু বললাম দেখি Doctor Lim কি বলে। কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বলল ডাক্তার ডাকছে।
Dr. Lim আমার সামনে এসে একটাই কথা বলল Lymphoma back করেছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, কোন কথা বলতে পারছিলাম না, বুঝলাম সব শেষ । ডাক্তার বললেন, Andrew কে বলব? আমি বললাম , বলতে তো হবে। ডাক্তার আমাকে computer screen এর সামনে নিয়ে গেলেন এবং দেখালেন। Adrenal Gland এ কিছু নাই কিন্তু Lymphoma ভাইরাস ডান দিকের লিভার এবং স্পাইনালে ছড়িয়ে গিয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প আছে। আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে ডাক্তার কে বললাম what next? ডাক্তার বললেন I am sorry, আমার আর কিছুই করার নাই। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে। নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিশোর বুঝতে পেরেছিল, আমাকে ডাকতে থাকে।
ডাক্তার কিশোর কে বলে Lymphoma back করেছে। কিশোর ডাক্তারকে বলে, তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো, আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না, আমি কাল দেশে ফিরব । আমাকে বলে, আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা, আমি তো কাঁদছি না, তুমি কাঁদছ কেন?
কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল, যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর high commission এ ফোন করে বলে, কালই আমার ফেরার plane ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশী ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে। ১০ জুন বিকালে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে air-ambulance করে দেশে ফিরে আসি আমরা।
ঈশ্বরের কি খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ positive result নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো negative result নিয়ে। আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কতদিন, সে এটা লিখেছিল “It’s difficult to predict but typically in terms of months rather than years”
এখন কিশোর কোন কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কি ভাব, বলে কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিয়ো না।
Cancer এর last stage খুব যন্ত্রনাদায়ক ও কষ্টের হয়। Andrew Kishor এর জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।
আমার মনে হল, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ । তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত শ্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
এটাই শেষ পোস্ট, এরপর আর কিছু বলা বা লেখার মত আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকবো, মেনে নিতে পারছি না।
এই অসময়ে, সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভাল থাকবেন আর Andrew KIshor এর প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন ও প্রাণ খুলে দোয়া করবেন। বিদায়।”