ঈদ বাজার: দাম বেশি, মানুষ এবার কিনছে কম

রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরের মোহাম্মদীয়া মার্কেটের খাদিজা কালেকশনে মেয়ের জন্য থ্রি পিস কিনতে এসে দাম শুনে ফিরে গেছেন আলী আসগর বাবু।

দোকানে এসে দাম জানতে চাইলে বিক্রেতা নাদিম মিয়া তাকে বলেন, সব তিনের (তিন হাজার) উপরে; তিনের নিচে কিছু নাই। এরপর স্ত্রীকে নিয়ে অন্য দোকানের দিকে চলে যান বাবু।

বেসরকারি এ চাকরিজীবী জানান, সম্প্রতি তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ঈদের পোশাক কিনে দেওয়ার জন্য মার্কেটে ঘুরছেন তিনি। তবে দামে মিলছে না।
বললেন, বাজেটে হচ্ছে না। দুই হাজারের মধ্যে কাপড় খুঁজছিলাম, পাচ্ছি না। দেখি অন্য কোথাও পাই কিনা।

শুক্রবার মিরপুরের বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, কর্মদিবসগুলোর তুলনায় ভিড় কিছুটা বেশি। এর মধ্যে কিছু দোকানে আবার বিক্রেতারা অলস সময় পাড় করছিলেন।

বিভিন্ন দোকানে পোশাক নিয়ে দর কষাকষি করতে দেখা গেল ক্রেতাদের। তবে বিক্রেতারা বললেন, যে পরিমাণে ক্রেতা সমাগম হয়েছে; ওই পরিমাণের বিক্রি নেই।

দর কষাকষিতে পেরে না উঠে মার্কেটে আসা অনেককে খালি হাতে ফিরে যেতেও দেখা গেল। কিছু ক্রেতা আবার সীমিত কেনাকাটা করে ঘরে ফিরেছেন।

মিরপুর ১০ নম্বরের হোপ প্লাজার রিদি ফ্যাশনে মেয়ের জন্য ওয়ান পিস কিনতে দরদাম করছিলেন হালিমা আক্তার। কাপড়ের দাম ৮০০ টাকা শুনে পোশাক না কিনেই তিনি ফিরে যান।

হালিমা বলেন, এই মার্কেটেই কাপড়ের দাম সবচেয়ে কম। এখানেই যদি এমন হয়, অন্য জায়গায় কেমন হবে বুঝতেই পারছেন। সব জিনিসের দাম বেশি, এ কারণে আয়ে আর কুলাইতে পারি না। নিজেদের জন্য কিছু কিনিনি। এবার মনে হয় মেয়ের জন্যও কিছু কিনতে পারব না। ফুটপাতে একবার দেখব।

দোকানটির বিক্রেতা রাজু আহমেদ বলেন, এক বছরের ব্যবধানে অর্ধেকের বেশি ক্রেতা হারিয়েছেন তারা। পাবলিকের কাছে টাকা নাই৷ কাস্টমার আসছে, ঘাটাঘাটি করতেছে৷ আমাদের এখানে সারাজীবন একই দাম থাকে। ঈদের জন্য বাড়ছে, এমন হলেও একটা কথা ছিল। অ্যাবিলিটি আগের মত নেই, তাই চলে যাচ্ছে।

ক্রেতা হারানোর কথা বললেন শানুয়ারা ফ্যাশনের বিক্রেতা মো. ইমরানও। জানান, গত ঈদের মত বিক্রি হচ্ছে না এবার। মার্কেটে যে পরিমাণ ভিড় হচ্ছে সে পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে না। যারা কিনতেছে তারা ২টার জায়গায় একটা কিনতেছে।

মিরপুর ১১ নম্বরের মোহাম্মদীয়া মার্কেটের অন্য দোকানগুলোর তুলনায় শিশু চত্বরে বেশ ভিড় দেখা গেছে। তবে মক্কা মদিনা বাণিজ্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. রাশেদ বলছেন, ভিড় হলেও বিক্রি তেমন হচ্ছে না; কারণ ক্রেতা একজন, তার সঙ্গে আরও চারজন দোকানে ভিড় করছেন।

তাও শুক্রবার দেখে ভিড় দেখছেন। মনমত বিক্রি হচ্ছে না। কেউ কেউ কিনতে আসে, অনেকেই দেখতে আসে।

জান্নাত বোরকা হাউজে বিক্রি হচ্ছে শিশুদের পার্টি ফ্রগ। দোকানটির ব্যবস্থাপক নাদিম হোসাইন বলেন, বছরের প্রথম ঈদ অনুযায়ী বাজারে যে চাপটা থাকার কথা, সেই চাপ এবার তারা এখনও পাচ্ছেন না।

তবে ঈদের ছুটি শুরু হলে বিক্রি বাড়তে পারে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।

নাদিম বলেন, গতবারের তুলনায় পোশাকের দাম এবার দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে যেসব ক্রেতা তিনটি পোশাক কিনতে আসত তারা এবার একটি পোশাক কিনছেন। একটা ছোট বাচ্চার ড্রেসই আটশ টাকা দাম। জিনিস কিনতে পারতেছি না। ব্যবসায়ীও মরতেছে, কাস্টমারও মরতাছে। কিনতেই পারতেছি না, বেচব কেমনে? কিনে জিততে পারলে, বেচে জিততে পারতাম। কাস্টমার মনে করে কমেই কিনছি, বুঝে না।

টাকা নাই কারোর কাছে, তাই বিক্রি নাই। মিডল ক্লাস পরিবার না ভিক্ষা করতে পারতেছে, না চুরি করতে পারতেছে। যাগোর কাছে কিছু টাকা আছে তারাও কেবল বাচ্চার জন্য কিনতেছে।

মার্কেটটির শাড়ির দোকান অনামিকার বিক্রেতা মিঠু ব্যাপারী বলছেন, গত রোজায় যেখানে তারা দিনে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় টাকার শাড়ি বিক্রি করতে পারতেন; সেখানে এবার দৈনিক কেবল ৫০/৬০ হাজার টাকার বিক্রি করতে পারছেন।

মানুষ ভয়ে বের হয় না কেনাকাটা করার জন্য, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ৷ সরকার যদি থাকত, তাইলে কেনাকাটা করত। খুব খারাপ অবস্থা। অন্যবার এ সময় ভিড়ের কারণে মার্কেটে ঢোকা যেত না, এবার পুরা মার্কেট ফাঁকা। ফাঁকার কারণে আপনার লগে কথা বলতে পারছি।

নান্নু মার্কেটের ফ্যাশন ফেয়ারে বিক্রি হয় ছেলেদের টিশার্ট, প্যান্ট, শার্ট। দোকানটির বিক্রেতা রাতুল আজিজ খান বলেন, পোশাকের দাম কিছুটা বাড়ায় এবার তারা অর্ধেকের মত ক্রেতা হারিয়েছেন। আগে পাঞ্জাবি কিনেও অন্যকিছু কিনত পরে পরার জন্য, এইবার পাঞ্জাবি কেনার পর আর কিছু কিনতে চাচ্ছে না। আমরা যে দামে কিনে আনছি সেটার কমে তো বিক্রি করতে পারি না। কাস্টমার আগের রেটই ধরে রাখছে, বেশি দামে নিতে চায় না। বসে আছি, এমন অবস্থা। মোটামুটি কমের মধ্যেই ছেড়ে দিচ্ছি৷ কারণ এ বাজারে না ছাড়লে আমাদের লস, যাই বিক্রি করি তাতেই লাভ। এ সময় তো ভরপুর কাস্টমার থাকার কথা। আগের বার এ সময়ে বসে থাকতে পারতাম না।

ছেলেদের শার্ট প্যান্ট বিক্রি হয় মামুনি ফ্যাশনে। দোকানটির বিক্রয়কর্মী মো. মুন্না বলেন, তাদের পোশাক প্রতি দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। এবার তাদের বিক্রি কমেছে ২০ শতাংশ। দিন দিন পরিবার তো বড় হচ্ছে, কিন্তু মানুষের বেতন তো বাড়ে না। বেতন জায়গা মতোই আছে। দাম বাড়লে কাস্টমার তো হিমশিম খাবেই৷ কাপড়ের দাম, সেলাইয়ের দাম সব বেড়েছে।

মিরপুর ১০ নম্বরের ছেলের পোশাকের দোকান ইসরাতে বিক্রি হচ্ছে ছেলেদের শার্ট, প্যান্ট, টি শার্ট, পাঞ্জাবি। ক্রেতা টানতে দোকানটিতে বিভিন্ন পোশাকের উপর ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে।

এতে ক্রেতা কিছুটা বাড়লেও আশানুরূপ বিক্রি করতে না পারার কথা বলছেন দোকানটির বিক্রেতা মো. ইব্রাহিম।

তিনি জানান, ঈদের কেনাকাটার জন্য যে চাপ হয়; ওই রকম চাপ এখনো পড়েনি। মানুষ অর্থনৈতিক চাপে আছে, সবকিছুর দাম বেশি। তাদের দিকে তাকিয়েই ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর দুই চারদিন গেলে দেখা যাবে, বাড়ে কিনা। অন্য বছর আরও আগে থেকেই চাপ পরত মার্কেটে।

মিরপুর ১০ নম্বরের শাহ আলী প্লাজা থেকে থ্রি পিস কিনেছেন সাদিয়া ইসলাম। তিনি বলেন, তার দুটো থ্রি পিস কেনার পরিকল্পনা ছিল তবে দামে না মেলায় একটি কিনেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি। আগের চেয়ে সাত/আটশত টাকা দাম বেড়েছে। এফোর্ট করা যাচ্ছে না। এ মাসে টিউশনি পেয়েছি, ভেবেছিলাম বাসার সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করব কিন্তু যে দাম হচ্ছে না, তাই কারোর জন্য কিছু কিনিনি।

মার্কেটটির বেবী কর্নারে বিক্রি হয় শিশুদের পোশাক। দোকানটির বিক্রেতা মো. সাকিব বলেন, এবার তাদের পোশাকের দাম বেড়েছে তিন থেকে চারশ টাকা; এতে ক্রেতারা তাদের কেনাকাটা সীমিত করেছেন। সবার বাজেট এক না। ৩০ শতাংশ ক্রেতা নাই। মানুষের আয় তো বাড়ে নাই। ক্রেতা আসে, কিন্তু দাম বেশির কারণে কিনতে পারছে না, যারা কিনছে তাদের কষ্ট হচ্ছে। যে আগের ঈদের পাঁচজনকে কিনে দিত, সে এবার তিনজনের জন্য কিনছে।

ছেলেদের পাঞ্জাবি-পায়জামা বিক্রি হয় অরবিট মার্টে। দোকানটির ব্যবস্থাপক মাহমুদুল আজমাইন বলছেন, এবার তাদের বিক্রি ৩০ শতাংশ কমেছে। যতটা বিক্রির আশা ছিল ততটা বিক্রি হচ্ছে না। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সবকিছুর দাম বেড়েছে- সব মিলিয়ে ক্রেতা নাই। শেষ ১০ দিন আরও বিক্রির আশা করছি।

তাসিন ফেব্রিক্সে বিক্রি হয় নারীদের থ্রি পিস ও গজ কাপড়। দোকানটির স্বত্বাধিকারী হুমায়ুন কবীর বলেন, রোজার শুরুর দিকে মোটামুটি বিক্রি হলে; দিন দিন তাদের বিক্রি কমে আসছে। আজকে যা ভিড় দেখছেন তা ছুটির কারণে। কিন্তু এবার তিনভাগের একবার বিক্রি কমে গেছে, কম দামি জিনিসের দিকে কাস্টমারের চাহিদা বেশি, দামি জিনিস কিনতে চায় না। মানুষের আয় কমে গেছে।

 

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.