ইসলামে প্রবীণদের অধিকার ও মর্যাদা
সাধারণ অর্থে প্রবীণ বলা হয়- বয়স্ক ব্যক্তিকে। প্রবীণদের শেষ বয়সের কর্মশক্তিহীন অবস্থা সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে প্রচুর বর্ণনা রয়েছে। এক আয়াতে মানুষের নিষ্কর্মা বয়স ও জ্ঞানহারা সময়ের কথা উল্লেখ করে আল্লাহতায়ালা প্রবীণদের জরাগ্রস্ততাকে বুঝিয়েছেন। মানুষের যখন বয়স বেশি হয় তখন সে জরাগ্রস্ত বয়সে এসে পৌঁছে। এ সময় তারা জানা জিনিস ভুলে শিশুর মতো হয়ে যায়। বৃদ্ধ বয়সের দুর্বলতা ও শুভ্র-সাদা চুলের অবস্থার বর্ণনাও রয়েছে কোরআনে কারিমে। অর্থাৎ মানুষের বৃদ্ধাবস্থা হঠাৎ ঘটা কোনো বিষয় নয়। এটা জীবনের নিয়ম বিশেষ।
যেহেতু এ সময় কর্মক্ষম হয়ে যায়, তাই সংসার পরিবার কিংবা সমাজের সে হয়ে যায় অনেকটা মূল্যহীন। অনেকে প্রবীণদের সংসারের বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, কিংবা বাড়ি থেকে বের দেয়। ফলে তাদের অমর্যাদাকর করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব ইসলামেরও শিক্ষা নয়, মানবিক কোনো কাজ নয়। অথচ ইসলামের প্রবীণদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যা আমরা আলোচনার শুরুতে বলেছি।
শুভ্রকেশী প্রবীণদের মর্যাদা: শুভ্রকেশ বিশিষ্ট মুসলিমের বিশেষ মর্যাদার কথা হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন। হজরত আমর বিন শোয়াইব তার পিতা ও দাদা থেকে বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাদা চুল উঠাতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা মুমিনের নুর। তিনি আরও বলেন, ইসলামে যদি কেউ সাদা চুল বিশিষ্ট হয় আল্লাহ তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন, একটি পাপ মোচন করে দেন এবং একটি পুণ্য লিখে দেন।’ – আহমাদ: ৬৯৩৭, আবু দাউদ: ৪২০২
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, যে মুসলিম সাদা চুল বিশিষ্ট হবে, কিয়ামতের দিন এটা তার জন্য আলো হবে।–তিরমিজি: ১৬৩৪
প্রবীণদের দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়া: হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, প্রবীণদের সঙ্গেই তোমাদের কল্যাণ, বরকত রয়েছে।-ইবনে হিববান: ৫৫৯
অধিক বয়সীদের বিশেষ মর্যাদা: হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তির সংবাদ দেবো না? তারা বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে দীর্ঘ আয়ু লাভ করে এবং সুন্দর আমল করে। -আহমাদ: ৭২১২
অন্য হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, নিশ্চয়ই শুভ্রচুল বিশিষ্ট মুসলিমকে সম্মান করা, আল্লাহকে সম্মান করার শামিল। আরেক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।– তিরমিজি
প্রবীণ পিতা-মাতার প্রতি করণীয়: আল্লাহতায়ালা পিতা-মাতার প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বলেন, … এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সঙ্গে নরমভাবে কথা বলো…। –সূরা বনি ইসরাঈল: ২৩-২৪
অনেক সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। এমনকি মারধর পর্যন্ত করে, স্ত্রীকে খুশি করার জন্য বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অচেনা জায়গায় ফেলে আসা, দূরপাল্লার গাড়ীতে তুলে দিয়ে পালিয়ে আসা, ডাক্তার দেখানোর কথা বলে জমি দলিল করে নিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দেওয়া, হাসপাতালে ভর্তির কথা বলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার কথা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। অথচ আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো- তাদের সঙ্গে এমন আচরণ তো দূরের কথা ‘উহ’ শব্দও করা যাবে না। বরং শ্রদ্ধাভরে নম্রভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সর্বক্ষণ তাদের জন্য আল্লাহর শেখানো দোয়া করতে হবে, যেন তাদের উভয়ের প্রতি মহান আল্লাহ রহম করেন।
এখানেই শেষ নয়, পিতা-মাতা অমুসলিম হলেও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। এক কথায়, প্রবীণদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা মুসলমানদের দায়িত্ব। তাদের প্রয়োজন পূরণ করা সবার কর্তব্য। বিশেষ করে নিকটাত্মীয়দের এটা মানবিক দায়িত্বও বটে।
এভাবে ইসলাম প্রবীণদের মূল্যায়ন ও সম্মান করেছে। ইসলাম আরও যেসব ক্ষেত্রে প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার অন্যতম হলো-
সালামে অগ্রাধিকার, নামাজ আদায়ে বিশেষ সুবিধা, এমনকি প্রবীণদের সম্মানে নবী করিম (সা.) ইমামকে নামাজ সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রবীণদের ইমামতিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি রোজা পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন, হজের ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ অর্থাৎ বদলি হজের বিধান দিয়েছেন এবং হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নৈকট্যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যকার প্রবীণ ও জ্ঞানী লোকেরা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর পর্যায়ক্রমে দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি, তারপর দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি তারা। -সহিহ মুসলিম: ৪৩২
বসার দিক দিয়ে অগ্রাধিকার: হজরত ওবায়দুল্লাহ বিন ওমর বলেন, আমি সোলায়মান বিন আলীর নিকট ছিলাম। এ সময় কোরাইশ গোত্রের জনৈক প্রবীণ ব্যক্তি প্রবেশ করলো। সোলায়মান বললেন, এই প্রবীণ ব্যক্তির দিকে লক্ষ্য করো, তাকে উপযুক্ত আসনে বসাও। -আহমাদ: ৪৬০
কথা বলায় অগ্রাধিকার: একবার হজরত আবদুল্লাহ ইবনু সাহল ও মুহাইয়াছা খাদ্যের অভাবে খায়বারে আসেন। ঘটনাক্রমে আবদুল্লাহ নিহত হলে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ঘটনাটি বলার জন্য মুহাইয়াছা অগ্রসর হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) মুহাইয়াছাকে বললেন, বড়কে কথা বলতে দাও; বড়কে কথা বলতে দাও। তিনি এতে উদ্দেশ্য করেছেন বয়সে প্রবীণ ব্যক্তিকে। -সহিহ বোখারি: ৭১৯২
ইসলামে প্রবীণদের ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেহেতু শেষ বয়সে শারীরিক কারণে ইবাদত-বন্দেগি করতে কষ্ট হয়, আর কষ্ট স্বীকার করে যে ইবাদত-বন্দেগি করা হয়, আল্লাহতায়ালা তা কবুল করেন। তাই শেষ বয়সে ইবাদত-বন্দেগির মাত্রা যথাসাধ্য বাড়িয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া প্রবীণদের কর্তব্য হলো- আত্মীয়-স্বজনদের যথাসম্ভব খোঁজ-খবর নেওয়া ও দোয়া করা। যেমন হজরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বৃদ্ধ অবস্থায় তার ছেলে হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান। এক সঙ্গে কাবা ঘর নির্মাণ করেন এবং তাদের জন্য ও পরবর্তী বংশধরের জন্য দোয়া করেন। -সহিহ বোখারি: ৩৩৬৪