গাজায় রাফা নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে গত কয়েক মাসের উদ্বেগময় পরিস্থিতির অবসান ঘটাল ইসরায়েল। তাদের এই তৎপরতা সুচিন্তিত বলে মনে হয়নি। ইসরায়েলি মিত্ররা সতর্ক করেছে, রাফায় আক্রমণ হলে স্পষ্টত সেখানে অবস্থানরত ১০ লাখের বেশি মানুষের আশ্রয় বিপন্ন হবে। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি পুরোদমে হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েলকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রের জোগান বন্ধ করে দেবেন, যা কয়েক দশকের মধ্যে ইসরায়েলি স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হুমকি। এদিকে ইসরায়েল দাবি করছে, হামাস যোদ্ধাদের চারটি ঘাঁটি ধ্বংস করতে হলে তাদের অবশ্যই রাফায় প্রবেশ করতে হবে। যদিও ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ, এই অভিযানে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। মোসাদের সাবেক এক কর্মকর্তার মতে, বড়জোর এটা কৌশলগত একটা পদক্ষেপ হতে পারে। অভিযান শেষ হওয়ামাত্রই গাজার অন্যান্য অংশের মতো হামাস সেখানে ফিরে আসবে।
তাহলে ইসরায়েলি সরকার সেখানে হামলা চালাচ্ছে কেন? প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, ‘পুরোপুরি জয়’ লাভের জন্য রাফায় আগ্রাসন অপরিহার্য। অস্পষ্ট এ কথার মানে হতে পারে, হামাসের সামরিক ও তৎপরতার সক্ষমতা ধ্বংস করে তাদের কাছ থেকে ইসরায়েলি জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা। যদি ইসরায়েল এ পথ বেছে নেয়, তাহলে এ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে ‘পুরোপুরি জয়ের’ কৌশল বলতে তারা কী বোঝাতে চাচ্ছে, তা স্পষ্ট করতে হবে।
ইসরায়েল সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও হামাসকে নির্মূল করতে পারেনি। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের মতে, যুদ্ধে ইসরায়েলের ১০ থেকে ১৪ হাজার যোদ্ধা মারা গেছে, যা অতিরঞ্জিত বলে মনে করা হয়। এখনও হামাস জিম্মিদের নিয়ন্ত্রণ করছে।
সরকারের ‘পুরোপুরি জয়ের’ নেশা ইসরায়েলের ইতিহাসে দেশটিকে বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বাইডেনের ঘোষণার আগে কানাডা ও ইতালি দেশটিতে নতুন করে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। কলম্বিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তুরস্ক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা এখনও বাতিল হতে পারে। তবে এই হুমকি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে কামানের গোলার মতো।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভয় দেখাচ্ছে। বিশ্ববিবেক ইসরায়েলকে বয়কট করছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের ক্যাম্পাসজুড়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসরায়েলপন্থি শিক্ষকদের অবস্থান সংকীর্ণ হয়ে আসছে। বিমানে ভ্রমণ বাতিলের ঘটনা পরিস্থিতি আরও কঠিনতর করে তুলছে এবং বিচ্ছিন্নতাকে জোরদার করছে।
ইসরায়েলে নিজ দেশেই ১ লাখ মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধের কারণে তাদের আয় ও মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। আর অসম্ভব হলেও গাজায় ‘পুরোপুরি জয়ে’র আশায় মৃত সেনাদের কারণে প্রতিদিন অসংখ্য পরিবার শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তথ্যপ্রমাণ বলছে, এই বিজয় অসম্ভব।
গত সপ্তাহের ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের এক জরিপে বলা হয়েছে, ৬২ শতাংশ ইসরায়েলি রাফায় অভিযানের পরিবর্তে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনায় প্রাধান্য দেয় এবং শুধু ৩২ শতাংশ হামলা চালানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। চ্যানেল ১৩-এর একটি জরিপে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ ইসরায়েলি ‘পুরোপুরি বিজয়’ অর্জিত হবে না বলে মনে করে।
যুদ্ধ বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাছের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কে অবিচ্ছেদ্য থাকবে। উত্তরে হিজবুল্লাহর সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির হুমকি কমে আসবে।
যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে গাজার ব্যাপারে বাস্তবসম্মত কোনো পরিকল্পনা নিতে ইসরায়েলকে পাশ্চাত্যে ও আরব মিত্রদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে সৌদি আরবের সম্পৃক্ততার চুক্তিটি ভালো ও টেকসই হতে পারে, যে জন্য যুক্তরাষ্ট্রও চাপ দিচ্ছে। এ ছাড়া ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্কে আদতে বড় ধরনের পরিবর্তনসহ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা আনতে এটি বহুমুখী পদক্ষেপ হতে পারে।
নিষ্ঠুর সত্য হলো, বেশির ভাগ ইসরায়েলির জন্য ফিলিস্তিনিদের জীবন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আসল সত্য হলো, তাদের ভাগ্য ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। কেননা, প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি হত্যা করা হয়েছে, যেখানে শিশু রয়েছে ১৪ হাজারের বেশি। যুদ্ধের সমাপ্তি মানে সংকটাপন্ন জীবনগুলো রক্ষা করা এবং যে কোনো নিষ্পাপ জীবন রক্ষা সবার জন্য বিজয়।
ইসরায়েল ভিন্ন ধরনের পথ বেছে নিতে পারে– জিম্মিদের মুক্ত করা, ফিলিস্তিনিদের জীবন রক্ষা করা, ইসরায়েলে বৈশ্বিক সম্পর্ক-বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত রাখা এবং চিরকালীন যুদ্ধে বিনাশ থেকে নিজেকে সুরক্ষা করা। পুরোপুরি জয়ের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি মূলত ইসরায়েলের জন্য মোটা দাগে পরাজয়ই টেনে আনছে।
ডালিয়া স্কাইন্ডলিন: রাজনৈতিক বিশ্লেষক; দ্য গার্ডিয়ান
থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম