ইসরায়েল প্রকাশ্য গণহত্যা চালাচ্ছে
ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর গণহত্যা চালানোর প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেছে, এ সত্য এখন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আলজাজিরার খবরে প্রকাশ, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা নীতি ‘শিথিল’ করে সেনাবাহিনীকে গাজায় স্থল অভিযানের অংশ হিসেবে যে কাউকে হত্যা করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে।
ইসরায়েলের রাজনীতিবিদ ও সেনারা প্রকাশ্যে গাজাকে ভূপাতিত করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বিলুপ্ত করার কথা বলাবলি করছে; গাজার ভূমিতে ইসরেয়েলি অভিবাসীদের আবাস স্থাপনের সুখকল্পনায় লিপ্ত। ফিলিস্তিনিরা খাদ্য, পানীয় জল, আশ্রয় ও চিকিৎসাসেবার মতো বেঁচে থাকার সব আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ থেকে বঞ্চিত; নির্বিবাদে আকাশ থেকে বোমা নেমে এসে ফিলিস্তিনকে বিকলাঙ্গ করে দিচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের বলা হচ্ছে নিজের ভূমি ও বাসস্থান ছেড়ে দক্ষিণের দিকে চলে যেতে। ইসরায়েল স্পষ্টভাবেই গাজার উত্তর দিকটা দখল করে সেখানে প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তা এলাকা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে; চাইছে অধিবাসীদের উচ্ছেদ করতে।
গণহত্যাবিশারদরা বলছেন, এই ব্যাপক নাশকতা কোনো ‘খল নেতা’ বা ‘উগ্রবাদী রাজনৈতিক গোত্রে’র প্রভাবে হচ্ছে না; বরং সবচেয়ে ভীতিকর হলো, গণহত্যাটি হচ্ছে সমর্থকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে, নীরবে।
কোনো গণহত্যার প্রতি এমন প্রকাশ্য ও সক্রিয় সমর্থন এর আগে দেখা গিয়েছে কিনা, আমি নিশ্চিত নই। উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের নানা প্রতিষ্ঠান একে হয় সক্রিয় সমর্থন দিচ্ছে অথবা এ বিষয়ে পুরোপুরি নীরবতা পালন করছে, যা সমর্থনেরই নামান্তর।
একটি গণহত্যা সংঘটিত হতে হলে দুটো জিনিস প্রয়োজন: গণহত্যা চালানোর অবকাঠামোগত ও বস্তুগত সামর্থ্য এবং গণহত্যাকে গণহত্যা না বলে অন্য কোনো নাম দিয়ে দেওয়া। পশ্চিমা বিশ্ব এই দুই ক্ষেত্রেই সমানভাবে অংশ নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র একটি নয়, দু-দুটি বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে ওই অঞ্চলে এবং স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, কোনো রাষ্ট্র বা দল এর মধ্যে ঢুকলে তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করা হবে। যুক্তরাজ্যও নৌবহর পাঠিয়ে এই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদে মদদ দিচ্ছে। আমেরিকা ইসরায়েলে প্রতিরক্ষা উপাদান ও অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে, যুদ্ধবিরতির আহ্বান খারিজ করছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে সাহায্য করার নামে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মিসরকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে উদ্বুদ্ধ করছে যেন তারা আর গাজায় ফিরে যেতে না পারে। বছরের পর বছর এসব সহায়তাই ইসরায়েলকে গণহত্যা পরিচালনার জন্য সক্ষম করে তুলেছে।
গণহত্যাকে আড়াল করার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে বলা হচ্ছে, দুনিয়াজুড়ে ইহুদিদের নিপীড়নের বিপরীতে এটি একটি বৈধ লড়াই। ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে চাকরি হারাচ্ছেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন অনেকে। সব ধরনের প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো সর্বশক্তিতে বলে যাচ্ছে, ফিলিস্তিনের নাগরিক জীবন ধ্বংস করার জন্য দায়ী হামাসই। ইসরায়েলের এ অভিযানকে দেখা হচ্ছে ‘হামাস নির্মূল’ অভিযান হিসেবে। যারা এ বয়ানের বিরোধী, তাদেরই কোণঠাসা করা হচ্ছে; মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
সংক্ষেপে বললে, পশ্চিমা সব প্রতিষ্ঠান এ মুহূর্তে ‘সভ্যতা’কে ‘বর্বরতা’ থেকে বাঁচানোর নামে ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যা সংঘটনে সংগঠিত মদদ দিচ্ছে।
এ নিবন্ধ লিখতে গিয়ে কেবলই ভয় হচ্ছে, সামনে আরও কী কী ঘটতে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনে ইতোমধ্যে যা ঘটেছে তার ব্যাপ্তি ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর এবং যা ঘটবে তা হবে আরও বীভৎস।
এরকম সময়ে কোনো কিছুই অস্পষ্ট থাকে না। আমাদের অনেকের কাছেই এটি দীর্ঘদিন আগে থেকেই পরিষ্কার ছিল কিন্তু এখন আর সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এ সময়ে এসে পনেরশ শতকের মতো দখলদারি চালাচ্ছে। হ্যাঁ, এর প্রক্রিয়া, কৌশল, নীতি এবং শক্তি ও ক্ষমতার রূপান্তর ঘটেছে।
কুশীলব পাল্টেছে, কিছু বিষয় জটিলতর হয়েছে, কিছু জটিলতা অবশ্য কমেছে। এভাবেই চলছে। এসব তাত্ত্বিক আলোচনা জরুরি বটে, কিন্তু এ মুহূর্তে নয়। এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, এসব কথা স্পষ্টভাবে উচ্চ স্বরে বলা– সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, ক্ষমতা ও সম্পদের লালসায় সব সময়ের মতোই লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।
এর আগে কিছু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কোটি কোটি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে বর্বর তকমা লাগিয়ে হত্যা করেছে; হত্যা করেছে আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে– আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দুনিয়ার আরও অনেক অংশে। নির্মমভাবে ধ্বংস করেছে সৌন্দর্য, সভ্যতা, সমাজ। ভিয়েতনামে নির্বিচার হত্যা চালিয়েছে, পারমাণবিক বোমা মেরেছে জাপানে। এ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে অন্ধভাবে লুণ্ঠন করছে। চাইলে আরও বহু কিছু বলা যায়, তবে এটি বলাই যথেষ্ট– ওদের লুণ্ঠন এখনও চলছে এবং ফিলিস্তিনে তা যতটা প্রকটভাবে দৃশ্যমান, অন্য কোথাও ততটা নয়।
এম মুহান্নাদ আয়াশ; কানাডার ক্যালগারির মাউন্ট রয়্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন উম্মে রায়হানা