নব্বুইয়ের দশকের অনেকখানি জুড়েই আমি একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকার টিভি রিপোর্টিং করতাম। একবার হানিফ সংকেতের সাক্ষাৎকার নিই তার বাড়িতে গিয়ে। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, লোকেরা আমার নিন্দা করে বলে, হানিফ সংকেতের মাল শেষ, এখন তিন মাসে একটা ইত্যাদি করে। তখন বিটিভির মাসিক ইত্যাদি চলে আসে প্রাইভেট প্যাকেজে, প্রচার হয় প্রতি প্রান্তিকে (তিন মাসে) একবার। হানিফ সংকেতের নিজের প্রতিষ্ঠান ফাগুন অডিও ভিশন এর প্রযোজক। বরাবরের মতো তিনি নিজেই এর পরিকল্পণাকারী, রচয়িতা, পরিচালক, উপস্থাপক। প্যাকেজে এসে অনুষ্ঠানগুলোর জৌলুষ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ‘ইত্যাদি’র যে জিনিসটি আমার সব সময় ভালো লাগত তা হচ্ছে খুব স্ট্রং সোশ্যাল কমিটমেন্ট। ইত্যাদি বহু মানুষের বহু সমস্যার সমাধান করেছে। সমসাময়িককালে ঘটতে থাকা সামাজিক অসঙ্গতিগুলো তিনি এমনভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে সমাজে বড় ধরণের একটা ধাক্কা লাগে। এতো স্ট্রং সোশ্যাল কমিটমেন্ট আর কোনো বাংলাদেশি ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় চোখে পড়েনি। মৌলিকত্বও ইত্যাদির আরো একটি চোখে পড়ার মতো বিষয়। হানিফ সংকেতের মাল যে শেষ হয়ে যায়নি আজও অব্দি ইত্যাদির আনপ্যারালাল জনপ্রিয়তাই এর বড় প্রমাণ। ২৯ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রচারিত ইত্যাদির একটি প্রতিবেদন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। আজ আমি এই বিষয়টি নিয়েই লিখবো।
ইত্যাদিই আমাদের জানিয়েছিল ডা. এড্রিক বেকারের কথা। তিনি নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালে। ১৯৬৫ সালে নিউজিল্যান্ডের অটাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিন এবং সার্জারী বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। মানবতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে যান ভিয়েতনামে। যুদ্ধাহত সিভিলিয়ানদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। একজন আহত মানুষের দেহে অস্ত্রোপচার করে তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলেন এড্রিক কিন্তু সেই সুস্থ মানুষ তিন মাস পরে তার কাছে এসেই মৃত্যুবরণ করেন। তখন থেকেই তার মধ্যে কিছু একটা ঘটে যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে সারা জীবন কাটাবেন। এরপর অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড থেকে শিশুরোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং ক্যাথলিক মিশনের সাথে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে আসেন। বেশ কিছুকাল মেহেরপুর এবং মির্জাপুরে কাজ করার পর ১৯৮৩ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার কালিয়াকুরি গ্রামে গিয়ে একটি হেলথ কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলেন।
২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৭৪ বছর বয়সে এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। টানা ৩২ বছর ডাক্তার বেকার কালিয়াকুরি গ্রামে নিজের নির্মিত হেলথ কেয়ার সেন্টারের মাধ্যমে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের স্বাস্থসেবা প্রদান করেন। নিউজিল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই মনীষী ব্যক্তিগত জীবনের সকল আরাম আয়েশ, সংসার ধর্ম বিসর্জন দিয়ে দূর বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের মানুষদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। বিয়ে করেননি, সন্তানের পিতা হননি, কোনো ধরণের ভোগবিলাসের কথা ভাবেননি, এমন কী মৃত্যুর প্রাক্কালে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা বা অন্য কোনো বড় শহরেও যেতে চাননি। শুধু একটিই অন্তিম ইচ্ছে ছিল। তার মৃত্যুর পরে যেন কোনো সহৃদয়বান বাংলাদেশি চিকিৎসক এসে এই হাসপাতালটির দায়িত্ব নেন। কিন্তু কোনো বাংলাদেশি ডাক্তার এড্রিক বেকারের অন্তিম ইচ্ছের প্রতি সম্মান দেখাননি।
একজন মার্কিন তরুণ চিকিৎসক ডা. জেসিন একবার এসেছিলেন কালিয়াকুরির এই হেলথ সেন্টার দেখতে। বেকারের মৃত্যুসংবাদ তাকে এতোই পীড়িত করে যে তিনি সিদ্ধান্ত নেন কালিয়াকুরিতে এসে এই চিকিৎসা কেন্দ্রটির দায়িত্ব নেবেন। অবশেষে ছোটো ছোটো চার বাচ্চা এবং স্ত্রী মেরিন্ডিকে নিয়ে ডাক্তার জেসিন কালিয়াকুরিতে চলে আসেন ২০১৮ সালে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই ডাক্তার। দুজন মিলে এখন চালাচ্ছেন এই চিকিৎসা কেন্দ্রটি। আর বাচ্চাদের ভর্তি করে দিয়েছেন গ্রামের স্কুলে।
এড্রিক বেকারকে গ্রামবাসী ভালোবেসে ডাকতেন ডাক্তার ভাই। জেসিনও এখন তাদের নতুন ডাক্তার ভাই আর তার স্ত্রী মেরিন্ডি ডাক্তার বিবি। এইসব খবর আমরা পেয়েছি হানিফ সংকেতের ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। যখন বাংলাদেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডাক্তার, অষুধ সবই প্রশ্নবিদ্ধ, ডাক্তারদের লোকে ডাকে কসাই, তখন এই যে কিছু ভিনদেশি মানুষ হাজার হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে চিকিৎসা সেবা নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন এ থেকে কী আমরা কিছুই শিখবো না?
গত অক্টোবরে আমি ঢাকায় গেলে দেখা হয় লেখক শওকত ওসমানের পুত্র জাঁনেসার ওসমানের সাথে। তার মধ্যে তারুণ্যের উচ্ছাস দেখে আমার খুব ভালো লাগে। বলি, জাঁনেসার ভাই, এই তারুণ্যের রহস্য কী? তিনি হাসতে হাসতে বলেন, রোজ সেদ্ধ করা শব্জি খাই। একটু থেমে বলেন, তরুণ থাকার জন্য না, যাতে কসাইদের কাছে যেতে না হয় এজন্য। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আমি দেখেছি ডাক্তারাতঙ্ক। তারা ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় পায়। টাকার জন্য ডাক্তাররা ভালো মানুষকে রোগী বানায়, ক্রিটিকাল অবস্থায় নিয়ে যায়, অপ্রয়োজনে অস্ত্রপচার করে, জটিল সব রোগের কথা বলে ভয় দেখায়, তারপর লক্ষ লক্ষ টাকা বিল করে। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনার হাজার হাজার নজির তো আমরা রোজই মিডিয়ায় দেখি। অষুধে ভেজাল, চিকিৎসায় ভেজাল, রক্তে ভেজাল। ডাক্তারের কাছে মানুষ যায় জীবন বাঁচাতে কিন্তু এখন ডাক্তারের কাছে কেউ গেলে আত্মীয়রা এই আতঙ্কে ভোগেন, মেরে ফেলবে না তো?
এরকম দুঃসময়ে প্রকৃত চিকিৎসা সেবার ব্রত নিয়ে যেসব ভিনদেশি মানুষ বাংলাদেশের অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের জন্য খুব বড় একটা স্যালুট। সেই সঙ্গে স্যালুট জানাই আমার প্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতকে, যিনি ক্রমাগত এই জাতির বিবেককে সজাগ রাখার জন্য ক্যামেরা নিয়ে ছুটছেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ১ ডিসেম্বর ২০১৯।