ইউরোপের দেশে দেশে ইভি বিপ্লব
আধুনিক বিশ্বে গাড়ির জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) সেবা। জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বর্তমান বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন ও ব্যবহার-দুটোই বাড়ছে। কারণ, ইঞ্জিনের বদলে মোটরের শক্তিতে গাড়ি চলায় শব্দ কম হয়। বেশির ভাগ বৈদ্যুতিক গাড়িই নিঃশব্দে পথ চলতে পারে। তবে রাস্তায় গাড়ির উপস্থিতি বোঝানোর জন্য কৃত্রিম শব্দ ব্যবহারের সুবিধাও রয়েছে অনেক গাড়িতে।
ইভি ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন-নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে সুইডেন৷ ছবি: সংগৃহীত
ফলে এক দশকে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে টেসলা, রিভিয়ান, এনআইও’র মতো গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও। প্রচলিত দ্রুতগতির গাড়ি প্রস্তুতকারক ভলভো, জিএম, নিসান এবং ফোর্ডও বাজারে এনেছে বৈদ্যুতিক গাড়ির পসরা।
ইউরোপীয় দেশগুলোও বিশেষ করে নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক এবং ফ্রান্স গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে বিশাল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে পেট্রোল এবং ডিজেলচালিত গাড়ি পুরোপুরি বন্ধ করে সড়কে শতভাগ বৈদ্যুতিক গাড়ি নামানোর পরিকল্পনা করছে। এরই অংশ হিসেবে নরওয়ে এবং নেদারল্যান্ডসে দ্রুত বাড়ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার হার। যা এই টেকসই গাড়ির ক্রমবর্ধমান আগ্রহ এবং চাহিদার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ইউরোপের পাঁচ দেশের বৈদ্যুতিক গাড়ির হালচাল নিয়ে মাল্টিনিউজের পাঠকদের জন্য বিশেষ আয়োজন ‘কারডিনো’ অবলম্বনে ‘‘ইউরোপের দেশে দেশে ইভি বিপ্লব’’
তেলের গাড়ি ছেড়ে বৈদ্যুতিক গাড়ির দেশে পরিণত হতে চলেছে নরওয়ে। ছবি: সংগৃহীত
নরওয়ে: বিশ্বে প্রথম তেলের গাড়ি ছেড়ে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ির দেশে পরিণত হতে চলেছে। গেল বছর দেশটিতে বিক্রি হওয়া নতুন ১০টি গাড়ির মধ্যে ৯ টিই ছিল ব্যাটারিচালিত। আর এবছর নরওয়ে শতভাগই পরিবেশবান্ধব বৈদুতিক গাড়ির দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে।
অসেলোর সবচেয়ে বড় কার আমদানিকারক কোম্পানি হ্যারাল্ড এ মোল ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভক্সওয়াগন আমদানি করে এসেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের শুরুর দিকে তারা জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত গাড়িকে বিদায় জানিয়েছে।
এখন দেশটিতে বিক্রির জন্য শোরুমে থাকা যাত্রীবাহী সব গাড়িই বৈদুতিক (ইভি)। নওরয়ের রাজধানীর রাস্তায় ব্যাটারি চালিত গাড়ি এখন হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। চারপাশে তাকালেই দেখা যাবে, প্রায় প্রতিটি গাড়ির লাইসেন্স প্লেটেই ইলেকট্রিকের ‘ই’শব্দটি লেখা রয়েছে।
বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় ৫৫ লাখ জনসংখ্যার নরওয়ে দ্রুত ইলেকট্রিক গাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এখন বিশ্বে নতুন জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত গাড়ি থেকে পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসা প্রথম দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে নরওয়ে।
নরওয়েজিয়ান রোড ফেডারেশন (ওএফভি) এর হিসাবমতে, গতবছর দেশটিতে বিক্রি হওয়া নতুন গাড়ির ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশই ছিল বৈদ্যুতিক গাড়ি। এ সংখ্যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৮২ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
কোনো কোনো মাসে দেশটিতে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে ৯৮ শতাংশ পর্যন্তও। অন্যদিকে, নতুন পেট্রোল ও ডিজেল চালিত গাড়ি বিক্রি প্রায় হয়নি বললেই চলে। ফলে নরওয়েকে বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির অগ্রদূত বলা যায়। দেশটিতে তিন দশক ধরে ঘটেছে এই বৈদ্যুতিক বিপ্লব।
নরওয়ের উপ-পরিবহনমন্ত্রী ক্রোগলান্ড বলেছেন, আমরা লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কাছে পৌঁছে যাচ্ছি। আমি মনে করি আমরা লক্ষ্যে পৌঁছে যাব।
২০৩০ সালের মধ্যে সব যানবাহনকে ইভি করার লক্ষ্য নেদারল্যান্ডসের। ছবি: সংগৃহীত
নেদারল্যান্ড: টেকসই জীবনযাপনের উদ্ভাবনী পদ্ধতির জন্য দেশটি বেশ পরিচিত। দেশটি একটি সাহসী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে, দেশের সব নতুন যাত্রীবাহী যানবাহনকে অবশ্যই শূন্য-নির্গমন মানে নিয়ে আসা। পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং একটি ইভি অগ্রগামী দেশ হিসেবে অবস্থানকে শক্তিশালী করা।
নেদারল্যান্ড বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারে ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দেশ হিসেবে স্থান অর্জন করেছে। এই সাফল্য পরিচ্ছন্ন গতিশীলতা সমাধানের দিকে রূপান্তরকে উৎসাহিত করার জন্য ডিজাইন করা একটি সাবধানে প্রণয়নকৃত কর নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসে ডিজেলচালিত গাড়ি সড়ক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন অনেকেই তেলের গাড়ি ছেড়ে বৈদ্যুতিক গাড়ির মালিক হতে চাইছেন। যা সম্ভাবনাকে আরও নতুনভাবে আশা দেখাচ্ছে। সড়কে শতভাগ পরিবেশবান্ধব গাড়ি নিশ্চিত করার লক্ষ্যকে এগিয়ে নিচ্ছে।
ইভি ছড়িয়ে দিতে দেশজুড়ে চার্জিং নেটওয়ার্ক বিকাশের পরিকল্পনা সুইডেনের।ছবি: সংগৃহীত
সুইডেন: দেশটি ২০৪৫ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ এটি অর্জনের জন্য, সরকার আগামী দশকের শেষ নাগাদ ২.৫ মিলিয়ন বৈদ্যুতিক গাড়ি চালুর লক্ষ্য নিয়েছে৷ ইভি ছড়িয়ে দিতে চার্জিং নেটওয়ার্ক বিকাশের পরিকল্পনা করেছে।
সুইডেনের বৈদ্যুতিক গাড়ির নীতির একটি মূল অংশ হল কম বার্ষিক রোড ট্যাক্স। এছাড়া দেশটি হালকা যানবাহনের জন্য একটি ‘জলবায়ু বোনাস’ নীতি নিয়েছে, যা ভোক্তাদের সবুজ ও টেকসই বিকল্পের দিকে নিয়ে যাবে। পাশপাশি আর্থিক প্রণোদনাও দিচ্ছে। এই নীতি শুধুমাত্র দেশের পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে না বরং এর নাগরিকদের জন্য অর্থনৈতিক সুরক্ষাও দিচ্ছে। এসব নীতি সুইডেনের ইভি গ্রহণের হারকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে, বৈদ্যুতিক গতিশীলতার দিকে স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করেছে।
বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারে অন্য দেশের জন্য মডেল হতে চাইছে ডেনমার্ক। ছবি: সংগৃহীত
ডেনমার্ক: নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি আর সবুজের সতেজতায় প্রাণবন্ত দেশটিও বৈদ্যুতিক গাড়ির পথেই হাঁটছে। টেকসই পরিবহনের দিকে রূপান্তরকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে অন্য দেশের জন্য মডেল হিসেবে অবস্থান সুদৃঢ় করতে চাইছে।
ডেনমার্কের ট্যাক্স সিস্টেম জিরো-ইমিশন যানবাহন ব্যবহারের প্রচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। স্ট্যান্ডার্ড রেজিস্ট্রেশন করের মাত্র ৪০% হারে ট্যাক্স করা হয়, যা তাদের মোট খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। যা ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
তাছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়িকে উৎসাহিত করতে নিবন্ধন করও ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। যা ভোক্তাদের জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এসবই বৈদ্যুতিক গাড়ির গতিশীলতার দিকে ডেনমার্কের পদক্ষেপকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। গাড়ি ব্যবহারে আর্থিক বোঝা কমিয়ে ডেনমার্ক টেকসই ও পরিবেশবান্ধব যানবাহনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বৈদ্যুতিক গাড়িকে নাগরিকদের জন্য গ্রহণযোগ্য তুলেছে।
সুপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক গাড়ির নীতি এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ফ্রান্স। ছবি: সংগৃহীত
ফ্রান্স: দেশটি ইউরোপের ইভি বাজারের শীর্ষে যাওয়ার পথ তৈরি করছে। সুপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক গাড়ির নীতি এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
গেল জানুয়ারি থেকে, বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য ইকো-বোনাস ৬,০০০ থেকে কমিয়ে ৫,০০০ করা হয়েছে। এই পদক্ষেপটি দেশের বিকশিত ইভি বিকাশের পথকে সহজ করে তুলেছে। এই নীতি পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে, যা ইভি শিল্পে দেশীয় এবং বৈশ্বিককে প্রভাবিত করে। বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার বাড়াতে এবং ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা আরও উন্নত করতে উৎসাহিত করবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
তুলনামূলকভাবে, উল্লিখিত পাঁচটি দেশের ইভি নীতি গাড়িবিশ্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তনেরই ইঙ্গত দিচ্ছে। সড়কে শতভাগ টেকসই, গতিশীল এবং পরিবেশবান্ধব যানবাহনকে উৎসাহিত করছে।টি ভোক্তাদের পছন্দকে প্রভাবিত করছে এবং স্থায়িত্বের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে।