মুন্সিগঞ্জে আড়িয়ল বিলের একাংশ ভরাট করে নির্মাণ হচ্ছে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পার্ক। বর্তমানে প্রকল্পটির ভূমি উন্নয়নের কাজ প্রায় শেষের দিকে। কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পার্ক ছাড়াও এখানে বিল ভরাট করে নির্মাণ হচ্ছে নানা আবাসন ও শিল্প-কারখানাও। তৈরি হয়েছে কিছু সড়ক। এতে আরো ভরাট হয়ে পড়েছে বিল। বাধাগ্রস্ত হয়েছে বিলের পানিপ্রবাহ। হুমকিতে পড়েছে দেশী মাছ এবং কৃষিকাজের বড় আধার হিসেবে পরিচিত আড়িয়ল বিল।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আড়িয়ল বিলে ধান ও বিভিন্ন রবিশস্যের চাষ হয়। বর্ষায় মাছ চাষ ছাড়াও অনেক শামুক পাওয়া যায় এখানে। একসময় এ শামুক বিক্রি করেও অনেকের জীবিকা চলত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জৌলুস হারিয়েছে আড়িয়ল বিল।
সরজমিন দেখা যায়, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পার্ক প্রকল্প এলাকায় ভূমি উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এজন্য বিলের একাংশ ভরাটের পর এখন আশপাশেও অনেক স্থানে তা ভরাট করে আবাসন প্রকল্পসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। বিলের ঠিক মাঝখান দিয়ে নির্মাণ হয়েছে বেশ কয়েকটি রাস্তা। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিলের পানিপ্রবাহ। বিলের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হওয়ায় এখন এখানে মাছের প্রাপ্যতা কমেছে। কমছে কৃষিজমির উৎপাদনশীলতাও।
আগে যেমন ছিল আড়িয়ল বিল
মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা আরমান আলী। বছর দুই আগে তিনি আড়িয়ল বিলের দুই বিঘা জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জমিতে আগের মতো ফসল হয় না। মাছও পাওয়া যায় কম। ধীরে ধীরে কৃষি ও মৎস্য এখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এজন্য একটি ডেভেলপার কোম্পানির কাছে জমি বিক্রি করে দিয়েছি।’
আড়িয়ল বিলে একসময় প্রচুর পরিমাণে শোল, গজার, কৈ, শিং, মাগুরসহ দেশী মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বিলের ভেতর পানিপ্রবাহ ব্যাহত এবং অনেকগুলো স্থাপনা নির্মাণ হওয়ায় এখন আর এখানে ঠিকমতো মাছ পাওয়ার পরিবেশ নেই বলে মন্তব্য করেছেন সিরাজদিখানের জেলে ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই এ বিলে মাছ ধরেছি। এখনো মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করছি। কিন্তু আগে যে পরিমাণ মাছ পেতাম এখন তার অর্ধেকও মেলে না। বিলের মাছের চাহিদা আছে ঠিকই। কিন্তু বিলে তো আগের মতো মাছ নেই। বিলের পানি এখন আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। জায়গায় জায়গায় রাস্তা হয়েছে। কোথাও আবাসন হচ্ছে। তাহলে মাছ হবে কীভাবে?’
আড়িয়ল বিল এখন যেমন
নির্মীয়মাণ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পার্কটির সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে গোটা আড়িয়ল বিলের প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য বড় ধরনের হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘দেশে এমনিতেই জলাভূমির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমছে। জলাভূমি কমার পেছনে বড় কারণ সরকারি প্রকল্প। আড়িয়ল বিলেও তাই দেখা যাচ্ছে। আমরা সেখানে বিমানবন্দর নির্মাণ করতে দিইনি বিল নষ্ট হবে বলে। এখন সেখানে কেমিক্যাল গোডাউন হচ্ছে। এটির সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না হলে পুরো এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়বে। শুধু মানুষ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্যান্য প্রাণীও। আমাদের পরিষ্কার দাবি, জলাভূমি বা বিল ভরাট করে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প করা যাবে না। আর এ শিল্প পার্কের ড্রয়িং, ডিজাইন সরকার পাবলিক ডোমেইনে প্রকাশ করেনি। আগে এটি প্রকাশ করা হোক।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ
আড়িয়ল বিল রক্ষায় ২০১০ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে শরিক হয়েছিলেন পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। বিলটির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে আড়িয়ল বিলের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। দেশী মাছের অন্যতম আধার এ বিল। এখানে পরিযায়ী পাখি আসে। কৃষির জন্যও এ বিলের খ্যাতি আছে। যেহেতু সরকারি বিভিন্ন অবকাঠামোর কারণে বিলটির ওপর বিরূপ প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, কালবিলম্ব না করে এখনই বিলটি সংরক্ষণে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক