আসছে বইমেলায় শতকোটি টাকার বই বিক্রি হতে পারে
গত বছরের মার্চে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় বাংলাদেশে। এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দেখা দেয় স্থবিরতা। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মহামারী কভিড-১৯-এর কারণে চলতি বছর বইমেলা সময়মতো শুরু করা যায়নি। এ অবস্থায় আগামী বৃহস্পতিবার শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা ২০২১।
বাংলা একাডেমির প্রত্যাশা, এ বছর মেলায় পাঁচ হাজার নতুন বই প্রকাশ হবে। বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে শতকোটিতে। এরই মধ্যে ৭ মার্চ বাংলা একাডেমি বইমেলার স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। তবে স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে বড় ও ছোট প্রকাশকদের মাঝে বৈষম্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রকাশকরা।
বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, করোনার কারণে এবারের বইমেলা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি বছর বইমেলায় প্রবেশ করতে এবং বের হতে ভিড়ের মধ্যে বেগ পেতে হয় পাঠকদের। এ বছর পাঠক-দর্শনার্থীরা যেন শারীরিক দূরত্ব মেনে মেলায় প্রবেশ করতে পারেন, এ দিকটি বিবেচনায় রেখে বাংলা একাডেমি ও টিএসসি প্রবেশপথের সঙ্গে নতুন আরেকটি প্রবেশপথ যুক্ত করা হয়েছে। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক জালাল আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের দিক থেকে একটি প্রবেশপথ দেয়া হোক। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বছর তৃতীয় প্রবেশপথ চালু করায় আমরা খুশি।
জানা গেছে, এবারের মেলায় অংশ নেয়া ৫২২টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৬০টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৬টি এবং বাকি স্টলগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপন করা হচ্ছে। বর্তমানে এ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মেলায় প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৩টি।
এবারের মেলায় ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। দর্শনার্থীরা যেন ঝড়-বৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেন, এজন্য চারটি বড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
অন্যবারের মতো এবারো মেলায় লেখককেন্দ্র এবং শিশু চত্বর রয়েছে। তবে শিশু প্রহর হবে কিনা এ বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করেনি বাংলা একাডেমি। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, মেলা শুরু হলে বোঝা যাবে শিশু প্রহর রাখব কিনা। মেলার নিরাপত্তার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশাসন প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছে।
এর আগে অমর একুশে বইমেলা হবে কিনা এ বিষয়টি নিয়ে দ্বিধা ছিল আয়োজক, প্রকাশক ও লেখকদের মাঝে। করোনা পরিস্থিতির কারণে মেলা অনুষ্ঠিত হবে না এমন সিদ্ধান্তও আসে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে। এ সিদ্ধান্ত প্রকাশনা শিল্পের জন্য মারাত্মক হুমকি উল্লেখ করে প্রকাশকরা মেলার ব্যাপারে পুনর্বিবেচনার দাবি জানালে বাংলা একাডেমি ১৮ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত মেলা আয়োজনের ঘোষণা দেয়।
এ বিষয়ে সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার দেরিতে বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারির আমেজ হয়তো পাওয়া যাবে না কিন্তু ২৬ মার্চের মতো দিবস ঠিকই পাচ্ছি। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বইমেলা হওয়াটা খুব জরুরি। এদেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার প্রবণতা খুবই কম। প্রকাশকদেরও ব্যবসার ব্যাপার আছে। বইমেলা না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। তবে এবার গরমের কষ্ট আমাদের সইতে হবে এই আরকি।
আরেক লেখক এমএ মোমেন বলেন, মেলা হবে না শুনে আমার মন প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে আবার যখন শুনলাম, মেলা হবে তখন খুব আনন্দ অনুভব করি। মেলা আয়োজনের পক্ষে যারা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি।
সরল রেখা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মো. নাজমুস সাদাত বলেন, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মেলা হচ্ছে, প্রকাশকদের জন্য এটিই আনন্দের কথা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব শতবর্ষে মেলার আয়োজন করতে না পারলে এক ধরনের শূন্যতা বয়ে বেড়াতে হতো। এখন তা আর হচ্ছে না।
মেলায় প্রকাশনা শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালক কাজী জহুরুল ইসলাম বুলবুল। তিনি বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর এটিই প্রথম বড় কোনো উৎসব। করোনার আগে বইমেলাই ছিল সর্বশেষ বড় উৎসব। আমার মনে হচ্ছে, এবারের মেলায় রেকর্ড পরিমাণ উপস্থিতি হবে। গত বছর ৮৩ কোটি টাকা বিক্রি হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এবার প্রায় শতকোটি টাকা বিক্রি হবে এমনটা আশা করা যায়।
মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদও তাই মনে করেন। তিনি বলেন, গত বছর চার হাজারের কিছু বেশি নতুন বই এসেছে। এবার পাঁচ হাজার বই আসছে। এবারের বিক্রি শতকোটি ছাড়িয়ে যাবে আশা করা যায়।
বরাবরের মতো এবারো মেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে ক্ষোভ দেখা গেছে প্রকাশকদের মাঝে। তবে এবারের অভিযোগ বেশি গুরুতর দাবি তাদের। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রকাশকদের অভিযোগ, বড় প্রকাশকদের মেলা প্রাঙ্গণের মাঝের অংশে একসঙ্গে প্যাভিলিয়ন দিয়েছে বাংলা একাডেমি। পাঠকরা বড় প্রকাশনীতে ভিড় জমাবে, এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মাঝারি প্রকাশকরা।
সালাউদ্দিন বইঘরের স্বত্বাধিকারী আলহাজ সালাউদ্দিন বলেন, করোনা প্রেক্ষাপটে প্রকাশকরাও বিপুল ক্ষতির সম্মুুখীন হয়েছেন। আশা ছিল বইমেলায় সে ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেবেন প্রকাশকরা। কিন্তু মেলা কর্তৃপক্ষ এমন এক বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে করে এবারের মেলায় গুটিকয়েক প্যাভিলিয়ন ছাড়া ছোট ও মাঝারি প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এবারের মেলায় ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে মজবুত করে স্টল বানানো হয়নি অভিযোগ করে ওই প্রকাশক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মেলায় অংশগ্রহণ করি। এবারের অংশগ্রহণ শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য। অন্যথায় এবারের মেলায় সব দিক থেকেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। ঝড়-বৃষ্টি হলে স্টল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলা একাডেমির এমন সিদ্ধান্তকে দায়িত্বহীন দাবি করে তিনি বলেন, আগামী বছর থেকে আমাদের দাবি থাকবে মেলায় যেন কোনো প্যাভিলিয়ন না রাখা হয়।
আরেক প্রকাশক বাবুইয়ের স্বত্বাধিকারী কাদের বাবু বলেন, বাংলা একাডেমি বড় প্রকাশকদের স্বার্থ দেখে স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। নতুন ও ছোট প্রকাশকদের প্রতি এটা বৈষম্য। আমাদের ব্যবসা খুব একটা ভালো হবে না, এটা আগেভাগেই বোঝা যাচ্ছে।
স্টল বরাদ্দে বইমেলায় ৬ নং প্যাভিলিয়ন পেয়েছে ঐতিহ্য। প্রকাশনাটির স্বত্বাধিকারী আরিফুর রহমান নাঈম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা দীর্ঘ ২১ বছর বইমেলায় যাচ্ছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, প্যাভিলিয়ন স্টলগুলোর প্রতিপক্ষ নয়। মানসম্মত ভালো বই করলে পাঠক স্টল খুঁজে নেবেই। তবে এবারের মেলায় আমাদের খুব বড় কোনো প্রত্যাশা নেই। করোনার ঝুঁকি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় নিয়ে মেলা হচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে শেষ হওয়াটাই কাম্য।
প্যাভিলিয়নগুলো এক জায়গায় হওয়ায় স্টল মালিকদের জন্য সুবিধা হয়েছে মনে করেন জিনিয়াস প্রকাশনীর (২৪ নং প্যাভিলিয়ন) স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমান রুবেল। কয়েক বছর আগে তিনি স্টলেই বইমেলা করতেন। সে অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্যাভিলিয়ন দিলে আশপাশের স্টলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ প্যাভিলিয়নে ঢুকে চলে যায়, আশপাশের ছোট স্টলে ঢোকে না। এ কারণে আমাদের যখন স্টল ছিল তখন আমরা দাবি তুলেছিলাম, প্যাভিলিয়নগুলো যেন সব এক জায়গায় দেয়া হয়। এখন সেটাই হয়েছে। প্যাভিলিয়নের কারণে ব্যবসা খারাপ হবে এর যৌক্তিকতা আছে বলেও মনে করেন না এ প্রকাশক।
মেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘এবারের মেলা হলো আমাদের উজ্জীবনের মেলা। স্টল বরাদ্দ থেকে শুরু করে সবকিছু খুব সুন্দর এবং ব্যতিক্রমভাবে সাজানো হয়েছে। তবে সবাইকে সন্তুষ্ট করা কখনই সম্ভব নয়। যারা পেছনে স্টল পেয়েছেন, তারা যদি বলেন আমাকে সামনে দেয়া হোক, তাহলে সবাইকে সামনে দেয়া কি সম্ভব হবে? সব মিলিয়ে প্রত্যাশা করছি, গত বছরের সফলতাকে ছাড়িয়ে যাবে এবারে বইমেলা।’
তবে করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এভাবে মাসব্যাপী মেলা করা ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেছেন কয়েকজন লেখক।