স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার সুপারিশ পেল বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাতে এই সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশ এমন এক সময়ে এই সুপারিশ পেল, যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করা হচ্ছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালের সিডিপির মূল্যায়নে তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ নির্দিষ্ট মান অর্জন করেছিল। এবারের মূল্যায়নেও সেই অর্জন ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
তবে এলডিসি থেকে বের হয়ে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার চূড়ান্ত স্বীকৃতি মিলতে বাংলাদেশকে আরো পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণত সিডিপির সুপারিশের তিন বছর পর চূড়ান্ত স্বীকৃতি মেলে। গত ১৫ জানুয়ারি সিডিপির সঙ্গে বৈঠকে করোনার কারণে বাড়তি দুই বছর সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। সিডিপি সেই অনুরোধ রেখে সুপারিশ করলে ২০২৬ সালে চূড়ান্ত স্বীকৃতি মিলবে। ঐ বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাওয়া যাবে।
এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশ কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। কিছু সুবিধাও মিলবে। অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর মনে করেন, বিষয়টি কোনো দেশের জন্য গৌরবের। জাতি হিসেবে সবাই চায় নিজেদের মর্যাদা ও গৌরব প্রতিষ্ঠিত করতে। এর ফলে আলাদাভাবে বস্তুগত সুবিধা না থাকলেও এই স্বীকৃতি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্মানিত করবে।
উল্লেখ্য, এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে রপ্তানি খাতে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পেয়ে আসছে। ইউএন সিডিপির তথ্যানুযায়ী, এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও চীনে অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (জিএসপি) শেষ হবে। তবে আশার দিক হলো, উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তুরস্কের বাজারে আরো তিন বছর জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাবে। এরপর ‘স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি’ পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। উত্তরণের পরপরই জাপান, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে স্ট্যান্ডার্ড জিএসপির চেস্টা করতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড জিএসপিতে শুল্ক হার ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়। এক্ষেত্রে এলডিসি নয় এমন দেশের তুলনায় কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। ভারতের বাজারে রপ্তানি করতে হলে ‘সাফটা’ ট্যারিফ দিতে হবে। কারণ এলডিসি হওয়ায় ভারতের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা ছিল।
রপ্তানির লাভ-ক্ষতি: ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ এলডিসি হওয়ায় শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেয়ে থাকে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ইউরোপের বাজারে ২১ বিলিয়ন ডলারের (১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা) রপ্তানি হয়েছে, যার মধ্যে ১৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের (১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) পণ্যই তৈরি পোশাক খাতের। গড়ে ১২ শতাংশ হারে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি বেড়েছে বাংলাদেশের। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে রপ্তানি কমতে পারে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের (১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) মতো। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাজার ধরে রাখা। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে যে বাড়তি শুল্ক দিতে হবে, তাতে করে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে থাকবে কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, তুরস্ক ও ভিয়েতনাম।
সার্বিকভাবে ৫ শতাংশ রপ্তানির ক্ষতি ধরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ২০২৭ সাল নাগাদ ৭ বিলিয়ন ডলার (৫৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) কম হতে পারে। ২০২৭ থেকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত মোট রপ্তানির ক্ষতি ২৮ বিলিয়ন ডলার (২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা) পর্যন্ত হতে পারে বলে জিইডির হিসাবে বলা হয়েছে। এলডিসির হিসেবে যে কোনো দেশ তার দেশে উত্পাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন কৃষি ও শিল্প খাতের নানা পণ্য বা সেবায় ভর্তুকি দেয়। এসব ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার চাপ আসতে পারে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে দেশের ওষুধশিল্প। কারণ এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরো কড়াকড়ি হবে। বর্তমানে এলডিসি হওয়ায় বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। এর কারণ, মেধাস্বত্বের (পেটেন্ট) ওপর অর্থ দেওয়া হলে ঐ ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। তবে ওষুধশিল্পের এই সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত পাবে বাংলাদেশ।
মন্তব্য জানতে চাইলে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই গৌরবের। তবে এজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। রপ্তানি খাতে যে ধাক্কা আসবে সেটি সামলানোর জন্য ‘কস্ট অব ডুইং বিজনেস’ কমিয়ে আনতে হবে। তাছাড়া ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা উঠে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। এজন্য উত্পাদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে।
বৈদেশিক সহায়তায় প্রভাব: বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক হতে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে ঋণ পেত। এরই মধ্যে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় উঠে যাওয়ায় বিশ্বব্যাংক এই সুদ হার বাড়িয়ে দিয়েছে। গড় হিসাবে এখন ২ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে অন্তর্বর্তী সুবিধা হিসেবে কিছু প্রকল্পে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হার সুদেও ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ায় রেয়াতকালও কমে এসেছে। এরই মধ্যে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় উঠে যাওয়ায় জাইকা তার ঋণের সুদ হার শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করেছে।
জাতিসংঘে চাঁদা বাড়বে: বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মোট বাজেটের শন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ চাঁদা দিয়ে থাকে। যার আর্থিক মূল্য ৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে দিতে হবে শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। তাছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা তহবিলে ৯০ শতাংশ ডিসকাউন্ট পেয়ে আসছে বাংলাদেশ।