‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানের শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় মারা গেছেন
‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর স্রষ্টা প্রতুল মুখোপাধ্যায় মারা গেছেন। ৮৩ বছর বয়সী এই সংগীতশিল্পী মৃত্যুর আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শনিবার (১৫ ফেব্রয়ারি) সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রতুল।
চলতি বছরের শুরুতেই জানা গিয়েছিল, গুরুতর অসুস্থ হয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তির পর প্রতুলকে পরীক্ষা করে দেখেন স্নায়ু এবং নাক-কান-গলার (ইএনটি) বিশেষজ্ঞরা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অস্ত্রোপচারের পর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন প্রতুল। এরপর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। সঙ্গে আবার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ ও নিউমোনিয়া। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠে। গত সোমবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ায় আইটিইউতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। শনিবার সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
১৯৪২ সালের ২৫ জুন অবিভক্ত বাংলার বরিশালে জন্ম প্রতুলের। বাবা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক। মা বাণী মুখোপাধ্যায় ও প্রতুলকে নিয়ে দেশভাগের পরে এপার বাংলায় চলে আসেন তিনি। থাকতে শুরু করে চুঁচুড়ায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতায় সুর দিতেন প্রতুল। কবি মঙ্গলচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতা দিয়ে শুরু।
নিজেও গান লিখতেন। অথচ প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষা তিনি নেননি। নিজের হৃদয় নিঃসৃত আবেগকেই সুর ও কথার মেলবন্ধনে বেঁধে ফেলতে শিখেছিলেন। যেভাবে আদিম মানব সহজাত ভঙ্গিতে গুহার নিঃসীম অন্ধকারে সুরের সাম্পানে পাড়ি দিত অচিন দেশে, সেভাবেই আজীবন প্রতুল নিজের হৃদয়ে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন গানের প্রদীপ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও চিকিৎসকদের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শোনাতেন তিনি। তবে এই একটিই গান নয়, প্রতুল সারা জীবন ধরে অসংখ্য মণিমুক্তো সৃষ্টি করে গিয়েছেন। বাংলা আধুনিক গান থেকে জাপানি গান, আবার হিন্দি ছবির গান থেকেও উপাদান সংগ্রহ করেছেন। সৃষ্টি করেছেন একের পর এক গান।
জীবনের প্রথম অ্যালবাম ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’ (১৯৮৮)। তবে সেটি একক অ্যালবাম নয়। অন্য শিল্পীদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হয়েছিল। এরপর ১৯৯৪ সালে ‘যেতে হবে’ প্রতুলের প্রথম একক অ্যালবাম। শেষ অ্যালবাম ‘ভোর’ (২০২২)। সেখানে সংকলিত হয়েছিল শিল্পীর অপ্রকাশিত গানগুলি।
তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ছাড়াও ‘আলু বেচো’, ‘ছোকরা চাঁদ’, ‘তোমার কি কোনও তুলনা হয়’, ‘সেই মেয়েটি’, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’-এর মতো গানও শ্রোতার মন জিতেছে বারবার। তবু কিছু সৃষ্টি তার স্রষ্টার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে যায়। প্রতুলের জীবনের ‘ম্যাগনাম ওপাস’ এই গান। বাংলা ও বাঙালির আত্মা যেন ওই গানে জলছাপের মতোই থেকে গিয়েছে। নিজের গানে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার কখনওই পছন্দ করেননি। কিন্তু অন্যান্য গানের মতোই ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গাওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত জাদুতে গানের কথার সুরেলা চলন মগ্ন করে রাখত শ্রোতাকে।
যতদিন বাঙালি শ্রোতা থাকবে, এই পৃথিবীতে বেজে চলবে গানটি। থেকে যাবে সেই গানের অমোঘ অনুরণন। থাকবেন প্রতুলও।