আক্রমণ থেকে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা প্রস্তুত ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী
যেকোনো আগ্রাসী আক্রমণ থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশ সদা প্রস্তুত ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আরো জানান, সেই লক্ষ্য সামনে রেখে সশস্ত্র বাহিনীকে সাংগঠনিকভাবে বিশেষায়িত সামরিক সজ্জায় সজ্জিত করা হচ্ছে। সশস্ত্র বাহিনী দিবস-২০২০ উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারিত হয়। সেখানে সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করার বিষয়ে নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’—এই মূলমন্ত্র দ্বারা আমাদের বৈদেশিক নীতিমালা পরিচালিত। আমরা প্রতিবেশী সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তবে যেকোনো আগ্রাসী আক্রমণ থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমরা সদা প্রস্তুত ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর প্রতিরক্ষানীতি ১৯৭৪-এর আলোকে আমরা ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন করেছি। তারই ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র বাহিনীকে সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠন, উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বিশেষায়িত সামরিক সজ্জায় সজ্জিত করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী সশস্ত্র বাহিনী দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে আজকের এই দিনটি এক বিশেষ গৌরবময় স্থান দখল করে আছে। ১৯৭১ সালের এই দিনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা যৌথভাবে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণের সূচনা করেন। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে শত্রু বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মহান আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাথা জাতি চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে যে সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম হয়েছিল, তা আজ মহীরুহ হয়ে বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’
শেখ হাসিনা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপারে জাতির জনকের নেওয়া কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা একটি উন্নত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করেছিলেন প্রতিরক্ষানীতি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সীমিত সম্পদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই গড়ে তোলেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, কম্বাইন্ড আর্মস স্কুল এবং সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার। বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তিনটি ঘাঁটি উদ্বোধন করেন। ভারত ও যুগোস্লাভিয়া থেকে নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহ করেন। ১৯৭৩ সালে সে সময়ের সুপারসনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমানসহ হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান এবং এয়ার ডিফেন্স রাডারের মতো অত্যাধুনিক সরঞ্জাম বিমানবাহিনীতে সংযোজন করেন। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীলগ্নে জাতির পিতা প্রণীত জাতীয় প্রতিরক্ষানীতির শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারি ও কর্মদক্ষতা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্রমের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে সর্বোচ্চ নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ‘সম্মুখসারির যোদ্ধা’ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অতীতে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নেও সশস্ত্র বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।’ তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তির বিষয় উল্লেখ করে অত্যন্ত গর্বভরে বলেন, ‘বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। এ বছর জাতিসংঘের ৭৫তম বছরপূর্তিতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমরা আবারও সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রদানকারী দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল পদবির অফিসার জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসেবে মনোনীত হয়েছেন এবং ফোর্স কমান্ডার হিসেবে একজন মেজর জেনারেল বা লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবির অফিসার নিয়োগের কার্যক্রম বর্তমানে চলমান রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রমের বিস্তৃতি এবং এই বাহিনীর সদস্যদের কল্যাণে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বর্ণনাও দেন ভাষণে। তিনি জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দুটি পদাতিক ব্রিগেড, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন, সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন ছাড়াও ১০টি ব্যাটালিয়ন, এনডিসি, বিপসট, এএফএমসি, এমআইএসটি, এনসিও’স একাডেমি ও বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টাল সেন্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সেনা আবাসন প্রকল্প, উন্নত মানের রসদ সরবরাহ এবং বহুতল সরকারি পারিবারিক বাসস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর শহিদ/মৃত/অবসরপ্রাপ্তদের অসহায় বিধবা পত্নীদের দুস্থ ভাতা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার, জেসিও এবং অন্যান্য পদবির সদস্যদের ছুটি নগদায়নের অর্থ প্রদান ১২ মাসের পরিবর্তে ১৮ মাসে উন্নীত করা হয়েছে। জেসিও ও অন্যান্য পদবির পেনশনযোগ্য চাকরিকাল ১৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর জেসিও ও অন্যান্য পদবির সদস্যদের জন্য মৃত্যুবরণ এবং স্থায়ীভাবে অক্ষম হওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বাবদ অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকারই সর্বপ্রথম সশস্ত্র বাহিনীতে নারী সদস্য নিয়োগ করে। গত বছর হতে সেনাবাহিনীতে পাঁচজন নারী সদস্য লে. কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে সম্মুখসারির যুদ্ধের ইউনিটসমূহের ইউনিট অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত আছেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আর্থ-সামজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ একটি সুপরিচিত নাম। করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে অনেক উন্নত এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ যখন ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির মুখে পড়েছে, তখনো আমাদের প্রবৃদ্ধি ৫.২৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের প্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন এবং রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ, আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবই। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম এবং পেশাগত দক্ষতায় বলীয়ান হয়ে দেশের প্রতিরক্ষা এবং দেশ গড়ার কাজে আরো বেশি অবদান রাখবেন।’