অস্বাভাবিক খরচ বৃদ্ধি: হজযাত্রী নিবন্ধনে সাড়া কম
চলতি বছর অস্বাভাবিক খরচ বৃদ্ধির কারণে হজযাত্রী নিবন্ধনে সাড়া মিলছে সামান্যই। হজ প্যাকেজের বিপুল মূল্যবৃদ্ধি, ৫৭ হাজার টাকা মাথাপিছু বিমানভাড়া বৃদ্ধি এবং কঠিন শর্তের বেড়াজালের কারণে প্রি-রেজিস্ট্রেশন করেও আর্থিক সংগতিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে চূড়ান্ত নিবন্ধন থেকে সরে যাচ্ছেন হজ গমনেচ্ছুরা। গত ৮ ফেব্রুয়ারি হজ নিবন্ধন শুরু হওয়ার পর গত ১৫ দিনে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার জন্য মোটে ১৩ হাজার ৫৪২ জন হজযাত্রী নিবন্ধন করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছে ৭১৫টি হজ এজেন্ট। এই পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার হজ নিবন্ধন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ধর্ম মন্ত্রণালয় গতকাল বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে হজযাত্রী নিবন্ধনের সময় আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। ঐ সময়ের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি উভয় ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধন করতে পারবেন।
সৌদি আরবের সঙ্গে হজচুক্তি অনুযায়ী, এ বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। তবে নিবন্ধনের এই গতিহীনতা ও অনীহার কারণে শেষ অবধি হজযাত্রীর কোটা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা করছেন হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। এজন্য হজযাত্রীদের বিমানভাড়া কমানোসহ প্যাকেজমূল্য পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে ট্র্যাভেল এজেন্সিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব)। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছেন তারা।
হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ও নানাবিধ সংকটের কারণে আর্থিক চাপে আছেন হজযাত্রীরা। তারা করোনার আগে যারা হজে যাওয়ার আশায় প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন তাদের বাজেটে টান পড়েছে। তারা যে বাজেটে হজে যাওয়ার টার্গেট করে রেখেছিলেন তার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবারের হজ প্যাকেজ ও বিমানভাড়া। ২০১৯ সালের তুলনায় এই ২০২৩ সালে হজের মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। সৌদি আরব হজের খরচ না বাড়ালেও টাকার সঙ্গে ডলার ও রিয়ালের বিনিময় হার বেড়েছে। এর চাপ এসে পড়েছে প্যাকেজে। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি বিমানভাড়া কমানোর ব্যবস্থা নেন, তাহলে সংগতিহীন হজযাত্রীদের জন্য হজ করার পথ সুগম হতে পারে। হজযাত্রীরা অনেক উপকৃত হবেন এবং তার জন্য দোয়া করবেন। তাই আমি হাবের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করব তিনি যেন বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। হাজিদের অর্থকষ্ট লাঘবে বিশেষভাবে আবেদন করছি।
আটাব সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, সারা বিশ্বে আর্থিক মন্দার কারণে যে ডলার-সংকট বিরাজ করছে তার প্রভাবে হজযাত্রীদের আর্থিক চাপ আরো বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি হজে যাওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবেন। বিমানভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারিত করা হলে হজযাত্রীদের আর্থিক ও মানসিক চাপ অনেকটাই কমবে। একজন বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিক বলেন, এবছর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মোট ৭১৫টি হজ এজেন্টের মাধ্যমে হজে যেতে পারবেন ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন। আমরা প্রচণ্ড রকম হতাশ। হজে যাওয়ার জন্য আমার এজেন্সির মাধ্যমে ২৫৫ জন প্রাক-নিবন্ধিত হজযাত্রী রয়েছেন। কিন্তু গত ১৫ দিনে মাত্র এক জন নিবন্ধনের জন্য ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। হজ খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে হজযাত্রীরা টাকা দিতে পারছেন না। তারা এখন ওমরায় যেতে চাচ্ছেন। এ বছর আমার এজেন্সি থেকে ৫৫ জন হাজিও পাব কি না, সন্দেহ। গতকাল পর্যন্ত ১৫ দিনে মোট নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬ হাজার ২৪২ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনা ৭ হাজার ৩০০ জন।
এদিকে ট্র্যাভেল এজেন্সিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া লিখিত আবেদনে বলেছেন, হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া এবার অনেক বেশি ধরা হয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রায় প্রত্যেক হজযাত্রীর ব্যয় হবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। পাশাপাশি পশু কোরবানির জন্য ন্যূনতম খরচ হবে ২৮ হাজার ৩৯০ টাকা। গত বছর কোরবানির খরচ ছিল ১৯ হাজার ৬৮৩ টাকা। এ বছর বেড়েছে ৮ হাজার ৭০৭ টাকা। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৭২ টাকা। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য সর্বনিম্ন প্যাকেজমূল্য ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে হাব। এর সঙ্গে কোরবানির খরচ যুক্ত হবে। এ বছর হজযাত্রী বিমানভাড়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা, যা গত বছর থেকে ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বেশি।
আটাব সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রে বলা হয়েছে, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে ২০১৫ সালে হজের সর্বনিম্ন খরচ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা, ২০১৭ সালে ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা, ২০১৮ সালে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল ৫ লাখ ২১ হাজার ১৫০ টাকা এবং ২০২৩ সালে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাব বিবেচনায় নিলে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৫ টাকা। এ বছর সৌদি সরকার হজের আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। চিঠিতে আরো বলা হয়, গত ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে হজযাত্রীদের নির্ধারিত বিমানভাড়া ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৩ সালে নির্ধারিত বিমানভাড়া আগের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিমানভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে হজের প্যাকেজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সৌদি রিয়ালের মূল্য হিসাব করে সৌদি আরবের খরচ নির্ধারণ করা হলেও হজের সময় রিয়ালের সঙ্গে টাকার বিনিময় মূল্যের হার বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া সারা বিশ্বে আর্থিক মন্দার কারণে যে ডলার-সংকট বিরাজ করছে, তার প্রভাবে হজযাত্রীদের আর্থিক চাপ আরো বৃদ্ধি পাবে। বিমানভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারিত করা হলে হজযাত্রীদের আর্থিক ও মানসিক চাপ অনেকটাই হ্রাস পাবে। এ অবস্থায়, ২০২৩ সালে হজের প্যাকেজে উল্লিখিত বিমানভাড়া কমানোসহ প্যাকেজ মূল্য পুনর্বিবেচনা করে হাজিদের অর্থ-কষ্ট লাঘব করার জন্য বিশেষভাবে আবেদন জানিয়েছে আটাব।
এ বিষয়ে আটাবের মহাসচিব আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, এ বছর হজে খরচ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। আগে যেখানে প্রিমিয়াম প্যাকেজের যাত্রীরা ৬-৭ লাখ টাকায় যেতেন, এবার সেখানে সাধারণ প্যাকেজেই খরচ পড়বে ৭ লাখ টাকা। বিশেষ করে বিমানভাড়া অত্যধিক বেশি ধরা হয়েছে। এজন্য হজযাত্রীরা অনেকেই মত পরিবর্তন করেছেন। তারা হজে যেতে পারবেন না বুঝতে পেরে এখন ওমরায় যাচ্ছেন। এ জন্য ওমরাহ যাত্রী এখন অনেক বেড়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, হজে বিমানভাড়া সর্বোচ্চ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা হতে পারত। কিন্তু প্রায় ৩৮ হাজার টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। হজে খরচ এত বেশি ধরায় এবার ৩০ হাজারের বেশি হজযাত্রী পাওয়া যাবে না বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, এ বছর বাংলাদেশ থেকে পবিত্র হজ পালনে যেতে পারবেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যেতে পারবেন ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে চলতি বছরের ২৮ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে।
হজের ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে হবে না: এদিকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের হজযাত্রী, হজ এজেন্সি ও সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, সৌদি সরকার হজযাত্রীদের ভিসার আবেদন লজমেন্টের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম চালু করেছে। নতুন নিয়ম অনুসারে এ বছর সব হজযাত্রীকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ভিসার আবেদন করতে হবে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ভিসার আবেদন প্রসেস করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে হজযাত্রীদের পাসপোর্ট আপাতত ঢাকার আশকোনার হজ অফিসে জমা না দিয়ে নিজের কাছে সংরক্ষণের অনুরোধ জানিয়ে এতে বলা হয়, ‘এরই মধ্যে যারা পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন তাদের হজ অফিস থেকে পাসপোর্ট ফেরত নেওয়ার জন্যও অনুরোধ করা হলো। এ বিষয়ে করণীয় হজযাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করা হবে।’
এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ধর্ম মন্ত্রণালয় হজযাত্রী নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, হজযাত্রীদের ভিসার জন্য নিবন্ধনের তিন দিনের মধ্যে পাসপোর্ট ও করোনা ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট নিজ দায়িত্বে ঢাকার আশকোনার হজ অফিসে জমা দিতে হবে।
হজ পালনে চার শর্ত সৌদির: এবার পবিত্র হজ পালনে চারটি শর্ত দিয়েছে সৌদি আরব। শর্তগুলো জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দেশটি। সৌদি আরবের দেওয়া শর্তগুলো হলো : করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯), মেনিনজাইটিস এবং সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দিতে হবে। যারা হজ করেননি এবারের হজে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া। হজ পালনের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স হতে হবে ১২ বছর। হজযাত্রীর কোনো বড় দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকা যাবে না।