অর্থের ইতিহাস
প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ অর্থ ও মুদ্রা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি উদ্ভাবন কালের পরীক্ষায় টিকে গেছে। উদাহরণত, মূল্যবান ধাতুর ব্যবহার হাজার হাজার বছর ধরে টিকেছিল। আর কাগজের টাকা এবং ব্যাঙ্ক নোটও ব্যাপকভাবে ও দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। কপার ধাতুর ঘাটতি দেখা দেওয়ায় ৮০৬ সালে চীনে প্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল।
কাঠবিড়ালির লোমশ চামড়া থেকে তৈরি মুদ্রা, কড়ি শাঁস, ইটালির পারমায় অঞ্চলে তৈরি পনির দিয়ে মুদ্রা ও বিনিময় ব্যবস্থায় যে পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালানো হয়েছিল তা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
এ ছাড়াও মুদ্রা ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করার জন্য আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। সেসবও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যবস্থা টিকে ছিল মাত্র ৫৪ বছর। যা ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার সময় বাতিল করা হয়।
আর বিনিময়ে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহারের ব্রেটন উড সংস্করণও প্রচলনের মাত্র ২৬ বছরের মধ্যে বাতিল করা হয় ১৯৭১ সালে। যখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন মার্কিন ডলার এবং স্বর্ণের মধ্যে সবধরনের পরিবর্তযোগ্যতার সমাপ্তি ঘটান। অর্থের বিবর্তন পৃথিবীতে মানুষের পদচারণা শুরুর দিন থেকেই অর্থ ও মুদ্রার অস্তিত্ব ছিল। গবাদি পশু থেকে শুরু করে বিটকয়ের পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে মুদ্রা ব্যবস্থা। আসুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক মুদ্রার বিবর্তন : দ্রব্য বিনিময় প্রথা ১ লাখ ২৮ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আফ্রিকায় আধুনিক মানুষরা প্রথম দীর্ঘ দূরত্বে দ্রব্র ও সম্পদের বিনিময় প্রথার প্রচলন করেন। ৮০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রথমদিককার কয়েকটি বাণিজ্য রুট গড়ে ওঠে। ৯,০০০ থেকে ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অন্যান্য দ্রব্য এবং সেবার বিনিময় মাধ্যম হিসেবে গবাদি পশু এবং শস্যের ব্যবহার শুরু হয়। ৩,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে (বর্তমান ইরাক) প্রথম ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা হয়। এতে লোকে শস্য, গবাদি পশু, কৃষিকাজে ব্যবহৃত হাতিয়ার এবং মূল্যবান ধাতু মজুদ করেন। মজার বিষয় হলো, ক্যাপিটাল, স্টক, বাক, ফি; ইংরেজি ভাষায় অর্থ সংক্রান্ত এমন অনেক পরিভাষার উৎপত্তি হয়েছে পশু বাণিজ্য থেকে। মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহার
১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এশিয়া, আফ্রিকা, ওশেনিয়া এবং ইউরোপের কিছু অংশে মুদ্রা হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল।
১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনের পশ্চিম ঝু রাজবংশ প্রথম ধাতব মুদ্রার ব্যবহার শুরু করে। ৬৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লিডিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) রাজা আলিয়াত্তেস প্রথম পশ্চিমা বিশ্বের ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেন।
মজার বিষয় হলো, ২০ শতকেও আফ্রিকার কিছু অংশে মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহার হত।
কাগুজে মুদ্রা ৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে ধাতব পদার্থ কপারের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় চীনা সম্রাট হিউয়েন সাঙ সর্বপ্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন করেন। ১৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে সুইডেন ইউরোপে প্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন করে। মজার বিষয় হলো, মার্কোপোলো ১২৭৫ খ্রিষ্টাব্দে দূরপ্রাচ্যে ভ্রমণে যাওয়ার আগে ইউরোপ কাগুজে মুদ্রা সম্পর্কে জানতেই পারেনি। স্বর্ণ মাণদণ্ড ১৮১৬ সালে ইংল্যান্ডের দাপ্তরিক মূল্য মানদণ্ড ঘোষণা করা হয় স্বর্ণকে। আর ইংল্যান্ড টাকশালে এক পাউন্ডের স্বর্ণ মুদ্রার মূদ্রণ করে। ১৮৭৯ সালে স্বর্ণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাপ্তরিক মূল্য মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর মাত্র ৫৪ বছর পর ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণকে মূল্য মানদণ্ড হিসেবে ত্যাগ করে।
ই মানি, ক্রেডিট কার্ড ও ডিজিটাল মুদ্রা ১৮৬০ সালে সর্বপ্রথম ওয়স্টার্ন ইউনিয়ন প্রথম ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তরের কার্যক্রম চালায়। ১৯৫০ সালে প্রথম ক্রেডিট কার্ড, কার্ডবোর্ড ডিনার’স ক্লাব কার্ড রিলিজ করা হয়। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম এটিএম চালু হয়। ১৯৯৯ সালে ইউরোপে মোবাইল ব্যাঙ্কিং শুরু হয়। ২০০৯ সালে বিটকয়েন পদ্ধতি, বিশ্বের সর্বপ্রথম ডিজিটাল মুদ্রার যাত্রা শুরু হয়। প্রথম বিটকয়েন লেনদেনের ঘটনা ঘটে ২১ মে ২০১০ সালে। এতে ১০,০০০ বিটিসি লেনদেন হয়। প্রোগ্রামার ল্যাসজলো হ্যানিয়েকস ওই ১০ হাজার বিটকয়েন ইংল্যান্ডের এক স্বেচ্ছাসেবির কাছে পাঠান। তিন ২৫ ডলার ব্যয় করে হ্যানিয়েকস এর জন্য একটি পিজার অর্ডার দেন। মজার বিষয় হলো মাত্র তিন বছর পর ওই পিজার দাম হয়েছে ৭, ৫০,০০০ ডলার!
অর্থের ইতহাসে নতুন অধ্যায় ২০০৯ সালে ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলনের মধ্য দিয়ে অর্থের ইতিহাসের নতুনতম অধ্যায় আমাদের চোখের সামনেই রচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নগদ অর্থ নিয়ে যুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক উচ্চমূল্যের ব্যাংক নোট বিলুপ্ত করার ডাক দিয়েছে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশে এই নগদ অর্থবিরোধী তৎপরতা বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে এর সবচেয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ হলো ভারতে ঘটে চলা মুদ্রারহিতকরণ প্রক্রিয়া। ২০১৬ সালের নভেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট রহিত করেন। তবে ভারতীয়রা এখন সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের নগদ নোট ব্যবহার করতে পারবেন। ৪ হাজার রুপির বেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে ব্যাংককে ব্যবহার করতে হবে। অথচ মাত্র ৫০% ভারতীয় নাগরিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
ভারতে মুদ্রারহিতকরণ প্রক্রিয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ১১২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আত্মহত্যা এবং ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতে ৩৫% মানুষ চাকরি হারান। আর মুদ্রারহিতকরণের ৩৪ দিনের মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেয় ৫০%।
শুরুতেই এর বিরূপ প্রভাব পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে এতে সুফল বয়ে আসবে বলেই বিশ্বাস অনেকের। বিশ্বব্যাপী এই নগদ মুদ্রার জন্য যুদ্ধ এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই যুদ্ধ শেষে হয়তো অর্থের ইতিহাসে আরেকটি নতুন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সুচনা হবে। সূত্র : বিজনেস ইনসাইডার