গৃহপরিচারিকাদের নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতনের পর তিন দিন বাথরুমে আটকে রাখার ঘটনায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অধস্তনদের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণ একেবারেই কাম্য নয়। ইসলাম গৃহশ্রমিকসহ অধস্তনদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছে।
রাসুলে আকরাম (সা.) এ বিষয়ে এরশাদ করেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ পাক তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন, সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায়, যা সে খায়; সে-ই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে। তাকে সামর্থ্যের অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে।’ (বুখারি)
ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের মালিকানা আল্লাহর। মানুষ সে সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যাবে না। পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা-স্নেহ, বিশ্বস্ততায় ভরপুর।
শ্রমের মর্যাদাদানের ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান অতি উচ্চে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা আল জুমার ১০ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেন, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ জীবিকা সন্ধান করবে।’ আল্লাহতায়ালা সুরা বালাদের ৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রমনির্ভর করে।’ ইসলাম একটি উচ্চ মানসিকতাসম্পন্ন শ্রমনীতির কথা ঘোষণা করেছে, যেখানে শ্রমিকের মানসম্মত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত হয় এবং কর্মসহায়ক পরিবেশ বিরাজমান থাকে।
রাসুলে পাক (সা.) বিদায় হজের ভাষণে ঘোষণা করেন- তোমরা তোমাদের অধীন লোকদের সঙ্গে সদাচরণ করবে। তোমরা যা খাবে, তাদের তা-ই খাওয়াবে; তোমরা যে পোশাক পরবে, তাদেরও সে মানের পোশাক পরাবে। তাদের শারীরিক বা মানসিকভাবে কষ্ট দেবে না।
একজন শ্রমিক তার শ্রম বিক্রি করে জীবিকার প্রত্যাশায়। শ্রমের মূল্য সে যাতে প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে পায়, এমনটিই নিশ্চিত করা হয়েছে ইসলামের বিধানে।
রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, নিজের শ্রমের উপার্জন উত্তম উপার্জন। কর্মহীনতাকে রাসুলে পাক (সা.) ধিক্কার দিয়ে বলেন, কর্মহীনতা মানুষকে পাষাণ করে দেয়। যারা শ্রম দেয়, তারা হলো শ্রমিক; তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে রাসুলে পাক (সা.) বলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ কর।’ (ইবনে মাজাহ)
তিনি আরও বলেছেন, ‘শ্রমিককে তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি কাজ দিও না। যদি কখনও এমনটি করতেই হয়, তবে তুমি নিজে তাকে সহযোগিতা করবে।’
রাসুলে পাক (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের ময়দানে আমি ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে মামলা দায়ের করব, যারা শ্রমিকের কাছ থেকে পূর্ণ কাজ বুঝে নিল, কিন্তু তাকে তার মজুরি দিল না।’ (মুসলিম)
পরিশ্রম করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের আল্লাহতায়ালার বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। রাসুলে পাক (সা.) নিজে পানি বহন করতেন। নিজের জুতা নিজে সেলাই করতেন। মসজিদ নির্মাণ, পরিখা খননসহ সামাজিক কাজে তিনি অংশগ্রহণ করতেন।
রাসুলে পাক (সা.) শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে শ্রমিক নিয়োগ দিতে নিষেধ করেছেন। (নাসায়ি)
শ্রমজীবীদের প্রতি রাসুলে পাক (সা.) কতটা দরদি ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বায়হাকি শরিফের একটি হাদিসে। জনৈক ব্যক্তি রাসুলে পাক (সা.)-কে বললেন, ‘আমার খাদেম আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অন্যায় করে। এখন আমি তার সঙ্গে কেমন আচরণ করব? উত্তরে তিনি বললেন, দৈনিক তাকে ৭০ বার ক্ষমা করবে।’
মানবতার মুক্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শ্রমিকদের কতটা ভালোবাসতেন এবং তাদের অধিকার প্রদানের বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দিতেন, তা হাদিসের বর্ণনা দ্বারা সহজেই বোঝা যায়।
প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আনাস (রা.) প্রায় ১০ বছর মহানবীর (সা.) খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। এ সময়ে রাসুলে পাক (সা.) কখনও তাকে ধমক দিয়ে কথা বলেননি।
হজরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, ‘একদা আমি আমার কাজের লোককে চাবুক দ্বারা প্রহার করছিলাম। এমন সময় পেছন থেকে কে যেন রাগের স্বরে আমার নাম ধরে ডাকছিলেন- হে আবু মাসউদ! হে আবু মাসউদ! আমি বুঝতে পারিনি, কে আমাকে ডাকছেন। কাছে আসার পর দেখলাম, রাসুলে পাক (সা.) এসেছেন। অতঃপর আমাকে বললেন, আবু মাসউদ! তুমি এই শ্রমিকের ওপর যতটা শক্তিশালী, মহান আল্লাহ কিন্তু তোমার ওপর তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী।’
রাসুলে পাক (সা.) বলেন, ‘অধীনদের জন্য খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করবে, তাদের ওপর সাধ্যাতীত কাজ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।’ (মুসলিম)
গৃহকর্তা হিসেবে অধস্তন যারা থাকবে, তাদের সুযোগ-সুবিধা দেখা, তাদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসা, অসুস্থতা বিবেচনা করাসহ তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারে ইসলাম যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা মেনে চললে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব।
লেখকঃ চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি