অটোরিকশা সেবায় নৈরাজ্য, জিম্মি নগরবাসী
অটোরিকশা সেবায় নৈরাজ্য থামছেই না। শুরুতে কয়েক মাস নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করেছিল অটোরিকশাগুলো। এরপর শুরু হয় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ২০-৩০ টাকা বেশি চাওয়া। পরে মিটার থাকলেও চালকরা চুক্তিতে চলাচল করতে যাত্রীদের বাধ্য করা শুরু করেন। মিটারের কথা বললে তারা যাত্রীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। সেই অবস্থা এখনো চলছে।
এ অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা-মালিক-চালকদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। এদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে নগরবাসী। এদিকে, নৈরাজ্য দূর করার উদ্যোগ নিয়েও চালক ও মালিকদের আন্দোলনের কারণে সরকারকে পিছু হটতে হলো।
রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকার রামপুরার বনশ্রী, মিরপুর, মিরপুরে বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনে, গাবতলী, আগারগাঁও, তেজগাঁও, শনির আখড়া, দোলাইরপাড়সহ বিভিন্ন জায়গায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে ওই সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ।
অটোরিকশাচালকদের সড়ক অবরোধে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। ছবি: সংগৃহীত
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অটোরিকশাচালকদের অবরোধের কারণে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে কয়েকজন উপদেষ্টা সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে দেওয়া চিঠি প্রত্যাহার করে। ফলে যাত্রীদের আগের মতোই বেশি ভাড়া দিয়ে চলাচল করতে হবে এবং নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে অটোরিকশাচালকদের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হবে। মালিকেরাও চালকদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করতে থাকবেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ও মালিকরা কখনোই নির্ধারিত ভাড়া ও জমার হার মানেননি। চালরা যাত্রীদের ইচ্ছা অনুযায়ী গন্তব্যে যেতে রাজি হন না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার এবং তৎকালীন সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অটোরিকশার মালিক ও চালকদের নৈরাজ্য টিকিয়ে রাখার সুযোগ দিয়েছেন। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার নৈরাজ্য দূর করার উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু অটোরিকশার চালক ও মালিকরা মানুষকে জিম্মি করায় সরকারকে পিছু হটতে হলো। কারণ, সরকারকে ইতিমধ্যে প্রায় ২০০ আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে। নিয়মিত ঢাকায় সড়ক অবরোধ হচ্ছে।
বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে সড়ক নিরাপত্তা সভায় বক্তব্য দেন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ছবি: সংগৃহীত
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ প্রসঙ্গে বলেন, অটোরিকশার চালক-মালিকরা আইন মানেন না, যাত্রীদের জিম্মি করেন, এটা ঠিক। সরকারকে বেশ কিছু আন্দোলন মোকাবিলা করতে হচ্ছে, হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দুর্ভোগ আর না বাড়িয়ে একটা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে আইন সবাইকে মানতে হবে। অটোরিকশার ক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হবে।
নৈরাজ্যের দুই দশক: রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের গণপরিবহনে অটোরিকশা যুক্ত হয় ২০০৩ সালে। তখন পরিবেশদূষণকারী বেবিট্যাক্সি ও মিশুক উঠিয়ে দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে সংখ্যা ছিল নির্দিষ্ট।
শুরুতে কয়েক মাস নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করেছিল অটোরিকশাগুলো। এরপর শুরু হয় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ২০-৩০ টাকা বেশি চাওয়া। পরে মিটার থাকলেও চালকেরা চুক্তিতে চলাচল করতে যাত্রীদের বাধ্য করা শুরু করেন। মিটারের কথা বললে তাঁরা যাত্রীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। সেই অবস্থা এখনো চলছে।
সব মিলিয়ে দুই দশক ধরে রাজধানী শহর ও বাণিজ্যিক নগর চট্টগ্রামে অটোরিকশা সেবায় নৈরাজ্য চলছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক ও চালকদের দাবির মুখে অন্তত পাঁচবার ভাড়া ও দৈনিক জমা বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু একবারও বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করতে পারেনি।
অটোরিকশাচালকদের সড়ক অবরোধে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। ছবি: সংগৃহীত
বর্তমানে অটোরিকশার মালিকের জন্য দৈনিক নির্ধারিত জমা ৯০০ টাকা। তবে চালকেরা বলছেন, মালিকেরা দিনে দুই বেলায় চালকের কাছে অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।
বর্তমানে অটোরিকশার মালিকের জন্য দৈনিক নির্ধারিত জমা ৯০০ টাকা। তবে চালকেরা বলছেন, মালিকেরা দিনে দুই বেলায় চালকের কাছে অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। অটোরিকশার বর্তমান সর্বনিম্ন (প্রথম দুই কিলোমিটার) ভাড়া ৪০ টাকা, অর্থাৎ একজন যাত্রী চাইলে ৪০ টাকায় অটোরিকশা ভাড়া করার সুযোগ পাবেন। দুই কিলোমিটারের পরের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা নির্ধারিত আছে।
অবশ্য চালকেরা ভাড়া নেন কার্যত দ্বিগুণ। দেড় শ টাকার নিচে স্বল্প দূরত্বের পথে যাওয়া যায় না। একটু বেশি দূরত্ব হলেই ভাড়া চাওয়া হয় আড়াই শ টাকা বা তার বেশি। বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন অথবা লঞ্চঘাটের মতো জায়গা থেকে কোথাও যেতে চাইলে অনেক বেশি ভাড়া হাঁকা হয়। সকালে অফিস শুরুর সময় এবং বিকালে ছুটির সময় ভাড়া বাড়িয়ে দেন চালকরা।