রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনী

হাজার বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে রাজা-রানি এসেছে অনেক, তবে তাদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

৭০ বছর আগে এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহনের ক্ষেত্রে তার নিজের কৃতিত্ব বলে কিছু ছিল না। বংশানুক্রমেই তার স্থান পাকা হয়েছিল।

কিন্তু রাজদণ্ড হাতে নেওয়ার পর তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, তাই মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করছে গোটা বিশ্ব।

ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান লিখেছে, নিয়মের অধীনে সিংহাসন পেলেও দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার দীর্ঘ শাসনকালের পট এঁকেছেন প্রায় নির্ভুলতার সঙ্গে।

বিবিসি মূল্যায়ন করেছে এভাবে, কর্তব্য নিষ্ঠা আর সিংহাসন আর জনগণের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করার উদাহরণ তৈরি করে গেছেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনএন লিখেছে, যুদ্ধের ধাক্কায় যখন উপনিবেশিক সাম্রাজ্য ধসে একের পর এক আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছিল, তখনও নেতৃত্বের গুণে সবার শ্রদ্ধার আসন অটুট রেখেছিলেন রানি এলিজাবেথ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৩ সালে যখন ব্রিটিশ সিংহাসনে দ্বিতীয় এলিজাবেথের অধিষ্ঠান ঘটে, তখন বিশ্ব খুব দ্রুত বদলাচ্ছে, অর্ধ পৃথিবীর অধিশ্বর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন পড়তির মুখে।

রাজা-রানির আর প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছিল জোরাল হয়ে। এই রকম একটা অস্থির সময়ে সিংহাসনে বসেন এলিজাবেথ। শুধু বসেননি, রাজতন্ত্রের অবসানেও রাজ পরিবারের গুরুত্ব তিনি হারাতে দেননি, নেন ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর জোট কমনওয়েলথের প্রধানের আসন।

পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলেছেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ, লিখেছে রয়টার্স।

সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ব্রিটিশ সিংহাসন অধিষ্ঠিত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি বেশ জাঁকজমকভাবে ‍তার সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর উদযাপন করেছিলেন। যুক্তরাজ্য এবং কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশে চার দিন ধরে নানা অনুষ্ঠানমালায় এই উদযাপন চলে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনে, এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি উইন্ডসর হিসেবে। তার বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং মা এলিজাবেথ বাউয়েস-লিয়ন। রাজা ষষ্ঠ জর্জের দুই সন্তানের মধ্যে এলিজাবেথ ছিলেন প্রথম। তার বোন প্রিন্সেস মার্গারেটের জন্ম ১৯৩০ সালে।

স্কুলে নয়, বাড়িতেই শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয় ছোট্ট এলিজাবেথের। তার শিক্ষক ছিলেন মারিয়ন ক্রাফোর্ড।

এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহনের পথ খোলে যখন তার চাচা রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড রাজদণ্ড ছাড়েন। ১৯৩৬ সালে অষ্টম এডওয়ার্ড পদত্যাগ করলে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ রাজা হন।

তখন এলিজাবেথের বয়স ১০ বছর হলেও সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন তিনি। ১৬ বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে প্রথম জনসম্মুখে আসেন এলিজাবেথ। ১৯৪৫ সালে প্রশিক্ষণের জন্য যোগ দেন সামরিক বাহিনীতে।

১৯৪৭ সালে প্রিন্স ফিলিপকে বিয়ে করেন এলিজাবেথ। গত বছরই জীবনসঙ্গীকে হারান রানি।

ফিলিপ ছিলেন গ্রিসের এক রাজপরিবারের সন্তান। তার বাবা প্রিন্স অ্যান্ড্রু ছিলেন হেলেনসের রাজা প্রথম জর্জের ছেলে। আর মা ছিলেন ব্যাটেনবার্গের প্রিন্সেস অ্যালিস। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের মাউন্টব্যাটেনরা ছিলেন তার মায়ের দিককার আত্মীয়।

১৯২২ সালে গ্রিসে অভ্যুত্থানের মুখে প্রিন্স ফিলিপের পরিবার দেশ ছেড়ে পালায়। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে পুরো পরিবারকে উদ্ধার করে নিয়ে যান ফ্রান্সে। পরে পরিবারটির আশ্রয় মেলে ইংল্যান্ডে।

প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে প্রিন্সেস এলিজাবেথের প্রথম দেখা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে। তখন প্রিন্সেস এলিজাবেথের বয়স ১৩। রাজা ষষ্ঠ জর্জ এসেছিলেন ডার্টমুথ কলেজ সফরে, সঙ্গে প্রিন্সেস এলিজাবেথ ও প্রিন্সেস মার্গারেট।

প্রিন্স ফিলিপ তখন নৌবাহিনীর এক তরুণ ক্যাডেট। দুই রাজকুমারীকে দেখভাল করার দায়িত্ব চাপে তার উপর। সুদর্শন ফিলিপ তখন প্রিন্সেস এলিজাবেথের মনে গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম হন।

এরপর দুজনের মধ্যে প্রেম জমে, শুরু হয় চিঠি চালাচালি। প্রিন্স ফিলিপ বেশ কয়েকবার রাজপরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য আমন্ত্রিত হন। সেসময় প্রিন্সেস এলিজাবেথের ড্রেসিং টেবিলে শোভা পেত প্রিন্স ফিলিপের ছবি।

১৯৪৩ সালে প্রিন্স ফিলিপ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রিন্সেস এলিজাবেথকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাদের বিয়েতে রাজপরিবারের কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিলেন এই বলে যে ফিলিপ ‘রুক্ষ ও অভদ্র’। তার জাতীয়তা নিয়েও আপত্তি ছিল।

তাই বাগদানের আগে প্রিন্স ফিলিপ গ্রিসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নেন, নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেন ‍মামাদের দিককার মাউন্টব্যাটেন পদবি।

বিয়ের অনুষ্ঠানের আগের দিন রাজা ষষ্ঠ জর্জ হবু জামাই প্রিন্স ফিলিপকে ‘হিজ রয়্যাল হাইনেস’ উপাধি দেন। আর বিয়ের দিন সকালে তাকে করা হয় ‘ডিউক অফ এডিনবরা’। এরপর ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর বিয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়েন ফিলিপ ও এলিজাবেথ।

সেই বিয়ে নিয়ে যুক্তরাজ্যের তখনকার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, দ্বিতীয় যুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনে ধূসর দিনগুলোতে ওই বিয়ে ছিল ‘রঙয়ের ঝলকানি’।

এ দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লসের জন্ম ১৯৪৮ সালে, মায়ের মৃত্যুর পর ইতোমধ্যে তাকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

তার ভাই-বোনের মধ্যে প্রিন্সেস অ্যানের জন্ম ১৯৫০ সালে, ডিউক অফ ইয়র্ক প্রিন্স অ্যান্ডুর জন্ম ১৯৬০ সালে আর সবার ছোট প্রিন্স এডওয়ার্ডের জন্ম ১৯৬৪ সালে।

২০২১ সালের ৯ এপ্রিল ৯৯ বছর বয়সে মারা যান প্রিন্স ফিলিপ। বিশ্ব তখন সবে কোভিড-১৯ মহামারীর থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। রানি ও তার স্বামী দুজনই কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রিন্স ফিলিপের কোভিড পরবর্তী কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছিল বলে শোনা যায়।

৭৩ বছরের বিবাহিত জীবনে এ দম্পতি অনেক বিষয়ে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল ছিলেন।

রাজপরিবারের একজন একান্ত সচিব একবার বলেছিলেন: “সারা বিশ্বে প্রিন্স ফিলিপ একমাত্র মানুষ, যিনি রানিকে নেহায়েত অন্য একজন মানুষ হিসাবে দেখেন, সেভাবেই তার সাথে ব্যবহার করেছেন। একমাত্র তিনিই এটা করতে পারতেন।”

প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই রানির জন্য বড় ধাক্কা ছিল।

বাবার মৃত্যুর পর রাজ্যপাটে

রাজা ষষ্ঠ জর্জের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করলে সিংহাসনের উত্তরসূরি হিসেবে প্রিন্সেস এলিজাবেথের কাঁধে রাজকীয় দায়িত্বের ভার বাড়তে থাকে।

১৯৫২ সালে স্বামীকে নিয়ে যখন কমনওয়েলথ সফরে এলিজাবেথ, তখন ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারা কেনিয়াতে অবস্থানকালে রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর খবর আসে।

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সেবছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যু হলে সিংহাসন চলে আসে এলিজাবেথের কাছে।

১৯৫৩ সালের ২ জুন ব্রিটিশ সিংহাসনে অভিষেক হয় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের। বয়স তখন তার ২৬।

তিনি আবদার করেছিলেন তার অভিষেক অনুষ্ঠানটি যেন সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হয়। রাজপরিবারের এই অনুষ্ঠানটির কিছু ঐতিহ্য ৯০০ বছর আগে থেকে চলছে। কিন্তু সেবার অনুষ্ঠানটি যত মানুষ দেখার সুযোগ পেয়েছিল, তেমনটি আগে কখনও ঘটেনি। সেদিন সাত ঘণ্টা ধরে টেলিভিশনে সরাসরি ওই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র আট বছর পর ধূসর লন্ডন নগরী জমকালো সেই উৎসবের জন্য নানা রঙে সেজে উঠেছিল। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে রানির অভিষেক অনুষ্ঠানটি হয়।

দায়িত্বে নিষ্ঠ রানি

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ একজন সাংবিধানিক রাজা। তিনি যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান; যদিও তার ক্ষমতা প্রতীকী ও আনুষ্ঠানিক। তাকে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যে আইন প্রণয়ন বা আইন পাস করার ক্ষমতা দেশটির পার্লামেন্টের হাতে।

যুক্তরাজ্যের নির্বাচিত সরকার রানিকে দেশ পরিচালনার বিষয়ে তথ্য দিয়ে থাকে, যা লাল রঙের একটি চামড়ার বাক্সে করে রানির কাছে পাঠানো হত। সাধারণত, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে বৈঠকের আগে তার সারসংক্ষেপ বা সেসব নথিতে রানির সই প্রয়োজন হবে, সেগুলো তার কাছে পাঠানো হত।

এছাড়া রানি যুক্তরাজ্যের সরকার নিয়োগ দেন। দেশটির জাতীয় নির্বাচনে যে দল জয়লাভ করে, তার প্রধানকে বাকিংহাম প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি রানির সঙ্গে দেখা করার পর রানি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠনের আহ্বান জানান। জাতীয় নির্বাচনের আগে চলমান সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার ঘোষণাও আনুষ্ঠনিকভাবে রানিই দেন। রানির ভাষণের মধ্য দিয়েই যুক্তরাজ্যে নতুন পার্লামেন্টের যাত্রা শুরু হয়। যেটি ‘স্টেট ওপেনিং সেরেমনি’ নামে পরিচিত।

যুক্তরাজ্যে আইন প্রণয়ন বা আইন পাস করার ক্ষমতা দেশটির পার্লামেন্টের হাতে থাকলেও সেটি আইনে পরিণত হতে আনুষ্ঠানিকভাবে রানির অনুমতি নিতে হয়।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে এসব দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ১৪ জন প্রধানমন্ত্রীকে সরকার গঠন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এছাড়া তার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ জন প্রেসিডেন্টের আসা-যাওয়া ঘটে।

যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি রাষ্ট্রের রানি এবং রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি যুক্তরাজ্যের শাসনকর্তা এবং চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধানও ছিলেন।

ব্রিটিশ রানি প্রথম এলিজাবেথ সংসার ধর্ম পালন না করে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন জনগণের জন্য। সেই নামেই রানির দায়িত্ব নেওয়া দ্বিতীয় এলিজাবেথ সংসার ধর্ম পালন করেই নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন জনগণের জন্য।

নিজের সিংহাসনে আরোহণের রজতজয়ন্তিতে তিনি বলেছিলেন, “যখন আমার বয়স একুশ, তখন আমি আমার জীবন জনগণের সেবায় উৎসর্গ করি এবং স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাকে প্রতিশ্রুতি রাখার শক্তি দেন। আমার কোনো খেদ নেই, কোনো পিছুটানও নেই।”

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.