হাওর জেলার কথা
হাওর জেলা কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা যার বেশিরভাগ এলাকা বছরের অর্ধেক সময় ডুবে থাকে পানিতে। বর্ষায় কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলী যদিওবা স্থলপথে যাওয়া যায় কিন্তু উপজেলা সদর থেকে গ্রামীণজনপদ তথা ইউনিয়ন ও গ্রামগুলোতে যাওয়ার একমাত্র বাহন নৌকা। গত ডিসেম্বর ১০, ২০১৯ তারিখে সকাল সাড়ে আটটায় আমাদের যাত্রা শুরু কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলীর সিংপুর ইউনিয়নের ভাটিবড়াটিয়া গ্রামের উদ্দেশে। এ যাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনস্থ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচির শিখন কেন্দ্রের দৈনন্দিন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করা।
কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলীর পথে
স্টেশন রোড, কিশোরগঞ্জ থেকে সিএনজি চালিত অটোরিক্সায় আমাদের ছুটে চলা নিকলীর পথে। জেলা সদর থেকে নিকলীর দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। সবটা পথ পিচঢালা হলেও কোথাও হাওর এর বুক চিরে তৈরি করা হয়েছে এ পথ। বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে আমাদের বহনকারী যানটি। রাস্তায় বাস বা ট্রাক জাতীয় কোনো পরিবহন নেই তেমন । দুই/চারটা সিএনজি আর বেশিরভাগ ইজিবাইক নামক তিন চাকার বাহন। এগুলো ব্যাটারিচালিত বাহন যা স্থানীয়দের নিত্য প্রয়োজন মিটিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু-পাশের উন্মুক্ত প্রান্তরে চোখ রাখতে রাখতে আমাদের এগিয়ে চলা। শীতের সকাল। এ সময়টাতে মাঠে তেমন ফসল নেই। বেশিরভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে। অল্পবিস্তর দুই/চারটা জমিতে সোনালী ধানের ছড়া যা দেখা যাচ্ছে সেগুলোও ঘরে তুলতে ব্যস্ত কৃষক পরিবার। জেলা সদর থেকে কয়েক কিলোমিটার যেতেই রাস্তার দু-পাশে চোখে পড়বে বড়ো বড়ো মাছের ঘের। এ ঘেরগুলোতে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে দেশীয় জাতের মাছ। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্য উকি দিতে থাকে আর আমরা আরও নিকটবর্তী হতে থাকি নিকলীর। আমাদের সিএনজি তখন ছুটে চলেছে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে। সহসায় আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায় পূর্ব থেকে দক্ষিণের বিস্তৃত প্রান্তরে। রাস্তার দক্ষিণের পাড় বড়ো বড়ো সিমেন্টের ইটে বাধানো পাড়। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে সবুজের সমারহ। দূরে কোথাও একটু আধটু খাদ; যেখানে জমে আছে পানি। যতদূর চোখ যায় খোলা আকাশ আর সবুজে সবুজময়। সিএনজি চালক আমাদের জানালেন- এটাই নিকলী বাঁধ। বর্ষায় পানিতে থৈ থৈ করে এর কূল কিনারা। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে পাড়ে। এমন প্রান্তরে দু-দন্ড না থেমে কি পারেন কোনো পথিক তার পথ চলতে। যদিও এখন শীতকাল। এখানে এখন আসে না তেমন কেউ কিন্তু বর্ষায় আসেন হাজার হাজার মানুষ এই নিকলীর সৈকতে বেড়াতে মনের মানুষ কিংবা পরিবার পরিজন নিয়ে। নাইবা হলো ঢেউগুলো আছড়ে পড়ার কাল কিন্তু সেই বাধ আর পাদদেশতো রয়েছে। তাইতো ক্ষণিক বিরতি দিয়ে আমরা বাধের প্রান্তর ছুয়ে পোঁছে গেলাম নিকলী উপজেলা সদরে।
আমাদের পথ তখনো শেষ হয়নি
বেলা তখন সাড়ে দশটা। নিকলী উপজেলার চার দিক দিয়েই হাওরে ঘেরা। বর্ষায় এখানকার মানুষের প্রধান বাহন নৌকা। মূলত বাধ ঘেষে গড়ে উঠেছে নিকলী উপজেলা শহর। আমাদের গন্তব্য আরো দশ/বার কিলোমিটার দূরের গাঁও ভাটিবড়াটিয়া। এটি একটি হাওর গ্রাম। এর সব দিকেই হাওর। বর্ষায় চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। দূর থেকে এটিকে পানি বেষ্টিত একখন্ড সবুজ পল্লী বলে মনে হয়। এখানকার প্রকৃতি রূপ ও রঙ বদলায় সময়ের তালে তালে। বর্ষায় যেখানে শুধু পানি আর পানি। বড়ো বড়ো ঢেউ আছড়ে পড়ে গ্রামগুলোর পাদদেশে। ঢেউ এর হাত থেকে গ্রামগুলোকে রক্ষা করার জন্য রড, সিমেন্ট আর বালি সুরকির পাত দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে প্রতিটি গ্রামে। এতে পানি প্রবেশে বাধা না হলেও ঢেউ থেকে গ্রামগুলো রক্ষা ঠিকই পাই। অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে হাওরের বেশিরভাগ এলাকা শুকিয়ে আসে। ফলে জেগে উঠে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি। সেখানে ফলে নানা রকমের ফসল। প্রধানত এই অঞ্চলের জমিগুলো এক ফসলি। বোরোধান এখানকার প্রধান ফসল। সাথে কিছু কিছু জমিতে ভূট্টা, চিনাবাদাম, সরিষা ও শীতকালীন সবজির চাষ হয়। হাওরের মানুষের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো বলা যাবে না; এ কারণে যে, এখানকার মানুষের বছরের অর্ধেক সময় কোনো কাজ থাকে না। ফলে অর্থনৈতিকভাবে এখনো কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে এই এলাকা, দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায়। বোরোধান হাওরের প্রধান ফসল হলেও প্রতিবছর কৃষকের ঘরে ওঠে না এই ফসল। কেননা কোনো কোনো বছর আগাম বর্ষা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সারাবছরের বেঁচে থাকার অবলম্বন বোরোধানের ক্ষেত। বর্ষায় এ অঞ্চলের অনেক মানুষ কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন শহরের দিকে। বিশেষ করে ভূমিহীন, প্রান্তিক মানুষের সিংহভাগ পরিবার পরিজন নিয়ে বড় শহরগুলোতে বাসা বাধেন কাজ ও জীবিকার জন্য। হাওর অঞ্চলের অন্যান্য গ্রামগুলোর মতই সাধারণ একটি গ্রাম ভাটিবড়াটিয়া। সিংপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম এটি।
হাওরের গ্রামীণ জীবনযাপন
সাধারণত হাওরের প্রতিটি গ্রামেই একটি করে বাজার রয়েছে। নিত্যপণ্যের সকল পণ্যই এখানে পাওয়া যায়। হাওরের গ্রামে গ্রামে বাজার বসার প্রধান কারণ হলো বর্ষায় কিংবা শকুনোর সময়ে যাতায়াত সমস্যার কারণে প্রতিটি গ্রামে বাজার গড়ে উঠেছে। এখানে বসবাসের ঘরগুলো খুব ঘন হয়ে থাকে। ছোটো একটু এলাকার মধ্যে অনেক মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গরু পালন করেন এর বাসিন্দরা। কেন গরু পালন করেন তার কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি রান্নার জ্বালানির জোগান অন্যতম কারণ বলে এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে। কেননা গরুর গোবর দিয়ে রান্নার জ্বালানি তৈরির দৃশ্য এখন হাওরের প্রতিটি বাড়ির সাধারণ দৃশ্য। ভাটিবড়াটিয়ার অবস্থান নিকলী উপজেলা সদর থেকে ১২/১৩ কিলোমিটার দূরে। এখন শুকনো মৌসুমের কারণে আমরা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে অতপর কিছুটা অংশ পায়ে হেটে আবার ইজিবাইকে পৌঁছালাম ভাটিবড়াাটিয়া আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্রে।
আশার আলো শিখন কেন্দ্রে আমরা
বেলা তখন সোয়া এগার। বার ছিল মঙ্গল। কেন্দ্রে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ২৪ জন। ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী ৩০ জন। ভাটিবড়াটিয়ার এই কেন্দ্রটির যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন লিজা আক্তার সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল থেকে। সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচির পাইলট কার্যকমের অংশ হিসেবে এটি শুরু করেছে ঢাকা আহছানিয়া মিশন । বর্তমানে এই কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে এফআইভিডিবি এর স্থানীয় সংস্থা ভোসড। শিখন-শিক্ষণ ব্যবস্থা হিসেবে মাল্টিগ্রেড পদ্ধতি অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে কেন্দ্রটি। মাল্টিগ্রেড ব্যবস্থায় একটি শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষক একই সময়ে একাধিক গ্রেড তথা শ্রেণির শিক্ষার্থীর শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।
ভাটিবড়াটিয়া আশার আলো শিখন কেন্দ্রের বাইরের ও ভিতরের পরিবেশ বেশ গোছানো এবং সাজানো। কেন্দ্রটি চলে সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত। একটি টিনের চালা ও বেড়া দেয়া দোচালা ঘরে পরিচালিত হচ্ছে কেন্দ্রটি। পথচারিগণ এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় সহেজই বুঝতে পারেন যে, এটি একটি শিক্ষা কেন্দ্র। প্রথমত কেন্দ্রের সামনে বাঁশের লাঠিতে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়। অন্যদিকে সারিবদ্ধভাবে সাজানো শিশুদের জুতা-স্যান্ডেল দেখলে যে কোনো মানুষের ভালো লাগবে। আমারও ভালো লেগেছে দৃশ্যটি দেখে। কেন্দ্রটির ভিতরের দৃশ্য বেশ মনোরম এবং বর্ণিল রঙে সাজানো শিশুদের আঁকা ও তৈরি নানা ধরনের ছবি এবং পোস্টার দ্বারা। তাছাড়া টাঙানো রয়েছে নানা ধরনের শিক্ষামূলক পোস্টার। আমরা যখন কেন্দ্রে উপস্থিত হলাম তখন পাঠ দান চলছিল ইংরেজি বিষয়ের। শিশুরা চারটি ছোটো টেবিল ঘিরে চারটি পৃথক দলে ভাগ হয়ে তাঁরা তাদের পাঠের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যেহেতু এটি একটি মাল্টিগ্রেড শিখন-শিক্ষণ ব্যবস্থা; সে কারণে প্রত্যেকটি টেবিল ঘিরে এক একটি পৃথক গ্রেড বা শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বসেছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এক একটি দলকে পৃথক নামে ডাকা হয়। যেমন এই কেন্দ্রে প্রথম শ্রেণির শিশুদের প্রারম্ভিক, দ্বিতীয় শ্রেণির অগ্রগামী, তৃতীয় শ্রেণির দক্ষ আর চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ডাকা হয় স্বাধীন নামে। শিক্ষক এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘুরে ঘুরে পাঠ প্রদান ও পাঠ অর্জনে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছেন। শিক্ষক লিজা ছিল বেশ তৎপর শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে। তিনি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে এই কেন্দ্রে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। পরবর্তীকালে বিষয়ভিত্তিক কিংবা অন্য কোনো প্রশিক্ষণ না পেলেও মাসিক উজ্জীবনি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে থাকেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি পরিশ্রমী এবং আন্তরিক। বিষয়ভিত্তিক পাঠদানের ক্ষেত্রে দলের কাজ পর্যবেক্ষণ এবং প্রত্যেক দলের শিশুদের পাঠে সহযোগিতার পাশাপাশি পাঠ মূল্যায়নও করতে দেখা গেল তাকে, শিশুদের পাঠবিষয়ক প্রশ্ন করার মাধ্যমে। একই সাথে লেখার যোগ্যতা যাচাই করতেও দেখা গেল শিশুদের খাতায় লিখতে দেয়ার মাধ্যমে। শ্রেণিকক্ষের শিখন-শিক্ষণ পরিবেশ ছিল অংশগ্রহণমূলক ও আনন্দদায়ক। শিশুদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ প্রবল। শেখার বিষয়ে আগ্রহ লক্ষণীয় মাত্রায় যা শিশুদের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে।
শ্রাবন্তি ও তার বন্ধুদের কথা
মাল্টিগ্রেড শিখন-শিক্ষণ ব্যবস্থায় দলভিত্তিক পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। ভাটিবড়াটিয়া শিখন কেন্দ্রে প্রথম যে দলের সাথে আমার পরিচয় হয়; সেটি হলো স্বাধীন তথা চতুর্থ গ্রেডের শিক্ষার্থীদের সাথে। পর্যায়ক্রমে প্রারম্ভিক, অগ্রগামী ও দক্ষ দলের সাথে আলাপ হয় প্রতিবেদকের। এখানেই কথা হয় শ্রাবন্তি ও তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে। পুরা নাম শ্রাবন্তি আক্তার। বয়স ১২/১৩ বছর। বর্তমানে পড়ছে ভাটিবড়াটিয়া আশার আলো শিখন কেন্দ্রে স্বাধীন দলে তথা চতুর্থ শ্রেণিতে। বাবা বোরহান উদ্দিন আর মা শাহানা আক্তার ঢাকায় ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। বর্তমানে শ্রাবন্তি তাঁর দাদীর সাথে একাই গ্রামে থাকে। প্রতিদিনের ঘরের কাজের পাশাপাশি রান্না তাকেই করতে হয়; কারণ তাঁর দাদি বয়স্কমানুষ। রান্না এবং ঘরের অন্যান্য কাজকর্ম তাঁর পক্ষে করা সম্ভব না। ঘরের কাজ করতে শ্রবন্তির কোনো কষ্ট হয় না। মা-বাবা ছাড়া একা একা দাদির সাথে গ্রামে থাকাতেই তাঁর বেশি আনন্দ; কারণ সে গ্রামে থাকছে বলেই পড়া-লেখার সুযোগ পাচ্ছে। আর সেটা সম্ভব হচ্ছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচির কারণে। সেকেন্ড চান্স এডুকেশন হচ্ছে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির একটি সাব-কম্পোনেন্ট। কেননা শ্রাবন্তিতো প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশু। পরিবারে অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে তার মা-বাবা প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন কাজের জন্য। মূলত ভাটিবড়াটিয়া গ্রামের অনেক মানুষ প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে এলাকা ছেড়ে ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে চলে আসেন কাজের সন্ধানে। শ্রাবন্তির মা-বাবাও তাদেঁর মধ্যে অন্যতম।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার আর তা হলো এইসব অভিভাবকের সাথে তাঁর স্কুল পড়ুয়া সন্তানেরাও গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। প্রথমত পরিবারে আরও যদি ছোটো ভাইবোন থাকে তাদের দেখার জন্য বাবা আর মার সাথে স্কুল পড়ুয়া ছেলে কিংবা মেয়েকে স্কুল ছাড়তে হয়। একনাগাড়ে কয়েকমাস স্কুল কামাই করার ফলে সে যেমন পাঠে পিছিয়ে পড়ে, তেমনি স্কুলের প্রতি অনাগ্রহ জন্মে তার। অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষও অনিয়মিত শিক্ষার্থীকে স্কুলে রাখে না। এভাবে অনেক শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। যেমনটি ঘটেছিল শ্রাবন্তির বেলায়। শ্রাবন্তিও ভাটিবড়াটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল কিন্তু পর পর দুই বছর মা-বাবার সাথে ঢাকায় চলে আসায় সেও স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। দ্বিতীয়বার স্কুলে ভর্তির সুযোগ ছিল না। স্থানীয় বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল সে। কিন্তু বছরের অনেকটা সময় স্কুল থেকে দূরে থাকার কারণে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও মানের দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে ছিল। সেকেন্ড চান্স এডুকেশন এর পাইলট কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা আহছানিয়া মিশন ২০১৭ সালে যখন ভাটিবড়াটিয়া আশার আলো শিখন কেন্দ্র নামে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে তখন শ্রাবন্তির চোখে সত্যিকার অর্থে আশার আলো জ্বলে উঠে পুনর্বার। এখন সে এই কেন্দ্রের নিয়মিত শিক্ষার্থী। শ্রাবন্তিরা দুই ভাই এবং এক বোন। বর্তমানে তার দুই ভাই মা-বাবার সাথে ঢাকায় যে ইটভাটাই তাদের মা-বাবা শ্রমিকের কাজ করছে সেখানে অবস্থান করছে। তারাও কি শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে? হয়তো তারা প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পাবে কিংবা পাবে না। তা হয়তো এই প্রতিবেদকের পক্ষে এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু শ্রাবন্তি এবং তার ভাইদের মত এমন দশ লক্ষ ঝরে পড়া শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ করে দিতেই যে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচির সূচনা সেকথা নিশ্চয় বলা যায়। ভাটিবড়াটিয়া আশার আলো শিখন কেন্দ্রের শুধু স্বাধীন দলেই শ্রাবন্তির আরো দুই সহপাঠী সুমাইয়া ও পাপড়িয়ার বাবা মাও ঢাকায় ইটভাটাই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়েছেন। ওদেরও জীবনের অভিজ্ঞতায় পরিবারের সদস্যদের সাথে ঢাকাই ইটভাটাই কাজ এবং থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। শুধু এরাই না আরও বেশকিছু শিশুর মা-বাবা জীবিকার জন্য ঢাকায় গিয়েছেন সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন তাঁদের স্কুল পড়ুয়া শিশুদের। এই সব শিশুর বেশিরভাগই ঝরে পড়ে বিদ্যালয়ের বারান্দা থেকে। জীবিকার প্রয়োজনে বেছে নেয় নানা কাজ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দির যোগ্য মানবসম্পদে নিজেকে তৈরি করতে পারে কি?
শিক্ষক লিজা আক্তারের অনুভূতি
বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়া বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে এই কেন্দ্রের শিক্ষক লিজা আক্তার জানালেন তার অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলছিলেন- শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই নয় আমাদের এই স্কুল থেকেও অনেকে হারিয়ে যায় জীবনের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে।
“জেসমিন আক্তার। আমার স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতো। পড়াশুনা নাচ, গানে ওর আগ্রহ ছিল প্রবল কিন্তু পরিবারের প্রয়োজনে সেও থাকতে পারেনি এই স্কুলে। সে এখন মা-বাবার সাথে ঢাকায় থাকে। ঢাকার কোনো এক ইটভাটাই তার মা-বাবা কাজ করছে আর জেসমিন তার ছোট ভাইকে দেখে রাখছে। জেসমিনের জন্য এখনো আমার খারাপ লাগে।”
আশার আলো শিখন কেন্দ্রে স্থানীয় কমিউনিটি তথা অভিভাবকদের অংশগ্রহণ
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর উদ্যোগে বেসরকারি সংস্থার দ্বারা পরিচালিত এই কেন্দ্রটিতে অভিভাবকদের দেয়া শিশুদের দুপুরের খাবারের বিষয়টি সত্যিকার অর্থে কেন্দ্রগুলোর স্থানীয় মালিকানা তৈরি ও স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করতে বড়ো ভূমিকা রাখবে। কেন্দ্রে শিশুরা প্রতিদিন নিজ নিজ বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। কেন্দ্র শেষ হবার আগে কোনো এক সময় সকল শিক্ষার্থী একত্রে দুপুরের খাবার গ্রহণ করে থাকে। শিশুরা বাড়ি থেকে খাবার এবং পানি নিয়ে আসে। কোনোদিন যদি কোনো শিশু খাবার না নিয়ে আসে তাহলে সেই দিন অপর শিশুরা নিজেদের খাবারের কিছুঅংশ অপরকে দিয়ে থাকে। এইগুণটি শিশুকে ভবিষ্যতে সুনাগরিক হতে সহযোগিতা করবে বলে এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে। দুপুরের খাবারের বিষয়টির মূল উদ্যোক্তা হিসেবে কিশোরগঞ্জের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর বর্তমান সহকারী পরিচালক জনাব আব্দুল মালেক এর ভূমিকা প্রশংসনীয়।
ঝরে পড়া শিশুদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া এবং কখনোই স্কুলে ভর্তি হয়নি এমন ৮ থেকে ১৪ বছরের শিশুর সংখা প্রায় ৪৩ লক্ষ। এই বিরাট সংখ্যক শিশুকে শিক্ষার আলো থেকে দূরে রেখে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব না। অন্যদিকে এসডিজির লক্ষ পুরণ শুধু থেকে যাবে কথা কথা হিসেবে। বর্তমান সরকার দেশের প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য “প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৪ এর একটি অংশ হিসেবে স্কুল বর্হিভূত এবং ঝরে পড়া এই সব শিশুদের জন্য সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি নিয়েছে; যা সকল ঝরে পড়া শিশুর জীবনমান ও কর্ম দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা না রাখতে পারলেও শ্রাবন্তি সুমাইয়াদের মত অন্তত কয়েক লক্ষ্য শিশুর জীবনে আশার আলো জ্বালাতে ভূমিকা রাখবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
লেখক পরিচিত
ডেপুটি ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর, সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, ঢাকা, ১২০৮