আমরা যারা অফিসে সারাদিন কর্মব্যস্ত সময় কাটাই তারা ভাবি, “যারা বাসায় থাকে, না জানি কত আরামের জীবন তাদের। বসের ঝাড়ি খেতে হয়না।” আবার আমরা যারা বাড়িতে কাজ করি; তারা ভাবি, “অফিসে মেয়েরা কত সেজেগুজে একটা ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে সারাদিন, কি আনন্দের জীবন, আবার মাস গেলে কতগুলো টাকা!” কিন্তু না, অফিসে ডেডলাইনের চাপ, কাজের কোয়ালিটি, পদোন্নতি হচ্ছে না, বেতন বাড়ছে না, কলিগের কানকথা, পথের জ্যাম, প্রপার গেটাপ ইত্যাদি যেমন কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ তৈরি করে তেমন বাড়িতে কাজের লোক সামলানো, বাজারঘাট, মাসের হিসাব, বাচ্চা সামলানো, ঘর পরিষ্কার হরেক রকম ঝামেলা থেকে মানসিক চাপ কিন্তু কম নয়। আমরা এখন ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে কম বেশি স্বাস্থ্যচর্চা, রুপচর্চা করি কিন্তু আত্মার শান্তির চর্চা কয়জনই বা করে থাকি।
বলছিলাম মেডিটেশন কিংবা ধ্যান করার কথা। হুম, মনে হতে পারে, কাজ করেই সময় পাই না আবার ধ্যান! তাই আগে ধ্যান সম্পর্কে জেনে নিই-
মেডিটেশন একটি মনোশারীরিক কৌশল যার প্রাথমিক লক্ষ্য হল চেতনার পরিবর্তন করে মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করা।
নতুন যুগে “ইয়োগা” নামটি বেশ জনপ্রিয়। প্রাচ্যের দর্শন, যোগ, হিন্দুধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মের মতো রহস্যবাদের ওপর ভিত্তি করে, যদিও এটি সাধারণত পশ্চিমা সংস্কৃতির সামাজিক প্রবণতা এবং বস্তুগত সমৃদ্ধি দ্বারা সমানভাবে প্রভাবিত। পশ্চিমে, মেডিটেশনের ওপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা, ১৯৭০ এর দশকে শুরু হয়েছিল। দক্ষ অনুশীলনকারীদের দ্বারা ব্যবহৃত ধ্যানের কৌশলগুলো নাড়ি এবং শ্বাসযন্ত্রের হার নিয়ন্ত্রণ, মাইগ্রেনের মাথাব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ এবং হিমোফিলিয়ার লক্ষণগুলো উপশম করতে কার্যকরভাবে প্রমাণিত।
১৯৬০-৭০ এর দশকে অনেক পশ্চিমা দেশে প্রাথমিকভাবে তরুণদের মধ্যে ভারতীয়, চীনা এবং জাপানি দর্শন এবং ধ্যান অনুশীলনের প্রতি আগ্রহের জাগরণ ঘটায়। ধ্যানের অসংখ্য কৌশলের শিক্ষা ও অনুশীলন বেশিরভাগ এশিয়ান ধর্মীয় ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে। উদাহরণস্বরূপ, “মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন” বৌদ্ধ ধর্মের কৌশলগুলোর একটি অভিযোজন। এটি ১৯৮০ এর দশকের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় হয়েছিল। সাইকোথেরাপির সংযোজন হিসেবে এর চিকিৎসা ব্যবহার ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। যার ফলে মানসিক চিকিৎসায় এটি গ্রহণ করা হয়েছিল।
বৌদ্ধধর্মে ধ্যান, মানসিক একাগ্রতার অনুশীলন যা পর্যায়ক্রমে আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা, নির্বাণের চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যায়। বৌদ্ধধর্মে মেডিটেশন একটি কেন্দ্রীয় অবস্থানে আছে। এর চারটি পর্যায়, যাকে (সংস্কৃতে) ধ্যানাস বা (পালি ভাষায়) ঝাঁস বলা হয়। বাহ্যিক সংবেদনশীল জগত থেকে মনোযোগের স্থানান্তর করা হয়: ১. বাহ্যিক জগত থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্যের চেতনা, ২. একাগ্রতা, যুক্তি এবং তদন্ত দমন, ৩. আনন্দের বিলুপ্তি, আরামের অনুভূতির সাথে, ৪. স্বাচ্ছন্দ্যের বিলুপ্তি, বিশুদ্ধ আত্ম-সম্পত্তি এবং সাম্যের অবস্থা নিয়ে আসে।
ইসলামে, ধ্যান বিভিন্ন অতীন্দ্রিয় ঐতিহ্যের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। মুসলিম নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:), যাঁর কাজগুলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একটি নৈতিক উদাহরণ প্রদান করে। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যান ও চিন্তায় কাটিয়েছেন। ইসলামে ধ্যানের দুটি ধারণা রয়েছে। যথা: তাফাক্কুর এবং তাদাব্বুর।
“তাফাক্কুর” যা আক্ষরিক অর্থে “মহাবিশ্বের প্রতিফলন” বোঝায়। মুসলিমরা অনুভব করে যে এই প্রক্রিয়াটি, যা শান্ত মনন এবং প্রার্থনা নিয়ে গঠিত। এটি ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণাকে গ্রহণ করে যা মানুষের মনকে জাগ্রত করে এবং মুক্ত করে। এটি ইসলামের বিশ্বব্যাপী শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা জীবনকে আল্লাহর প্রতি অনুগতদের আত্মসমর্পণের পরীক্ষা হিসেবে দেখে। এই ধরনের ধ্যান মুসলমানরা পবিত্র হজ্বের দ্বিতীয় পর্যায়ে, আরাফাত পর্বতে তাদের ছয় থেকে আট ঘণ্টা অবস্থানের সময় অনুশীলন করে।
“তাদাব্বুর” ধ্যানের দ্বিতীয় রূপ হল সুফি ধ্যান, যা মূলত রহস্যময় ব্যায়ামের ওপর ভিত্তি করে। এই ব্যায়ামগুলো বৌদ্ধধর্মের ধ্যানের অনুরূপ অনুশীলনগুলো নিয়ে গঠিত, যা “মুরাকাবা” বা “তামরকোজ” নামে পরিচিত। “মুরাকাবা” গভীর মনোযোগ এবং চিন্তার একত্রীকরণের পরামর্শ দেয়।
কর্মক্ষেত্রে ধ্যানের উপকারিতা
ধ্যান শুধুমাত্র কাজের সন্তুষ্টি বাড়াতে সাহায্য করে না, বরং উৎপাদনশীলতা এবং সাধারণ সুখও বাড়ায় বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি একজন কর্মচারীকে কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জনে সাহায্য করে। ব্যক্তিগত এবং সাংগঠনিক উভয় স্তরেই সুদূরপ্রসারী উপকার করে।
১। মানসিক চাপ কমায়: যখন কেউ মানসিক চাপে থাকে, তখন স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল প্রদাহ-প্রচারকারী রাসায়নিক নিঃসরণ করে যা সাইটোকাইন নামে পরিচিত। এগুলো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, হতাশা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বাড়ায়, রক্তচাপ ওঠানামা করায়। মেডিটেশন ঘুম নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, কর্টিসল হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে। এন্ডোরফিন, ডোপামিন এবং সেরোটোনিনের মতো সুখি হরমোন নিঃসরণকে উৎসাহিত করে। এটি কর্মীদের চাপমুক্ত হতে সাহায্য করে। যা তাদের কাজকে গতিশীল করে।
২। সৃজনশীলতা বৃদ্ধি: কর্পোরেট ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য ব্যক্তিদের অত্যন্ত সৃজনশীল হতে হয়। এই প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রিয়েটিভ কাজের জন্য প্রতিনিয়ত নতুনত্ব খোঁজা হয়। বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে ধ্যান করলে সৃজনশীলতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি হয়।
৩। মনকে শান্ত করে: যখন আপনি নিয়মিত ধ্যান করেন, তখন আপনি আপনার মনোযোগকে পুনঃনির্দেশিত করতে, আপনার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং প্রলোভন থেকে মুক্তি পান। যেমন, এটি আপনার আত্মা এবং মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। এটি ফোকাস বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত কার্যকর। যা কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৪। আত্ম-সচেতনতার উন্নতি: আত্ম-সচেতনতা ব্যক্তির চারপাশের সচেতনতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ধ্যান আত্ম-সচেতনতাকে ব্যাপকভাবে উন্নীত করতে সহায়তা করে। ব্যক্তি তার আবেগ, অনুভূতি, চিন্তাভাবনা এবং মনের ভিতরে যা ঘটছে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হতে সক্ষম হয়। এটি কর্মীদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে।
৫। সম্পর্কের উন্নতি: অসামান্য ফলাফল অর্জনের জন্য একটি ভালো দল অপরিহার্য। ভাল যোগাযোগ এবং বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে মেডিটেশন একটি অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। যা আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ককে উন্নত করে। কর্মক্ষেত্রে ধ্যান কেবল দলের সদস্যদের বন্ধনকে উন্নত করে না, বরং প্রত্যেকের জন্য ভাল দলগত অংশগ্রহণ এবং উন্নত মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
কাজের মাঝে সহজ ধ্যান অনুশীলন:
কর্মক্ষেত্রে সর্বদা ধ্যান অনুশীলনের জন্য সময় পাওয়া অবশ্যই কঠিন। তবু, কিছু সহজ কৌশল আছে যেগুলো ব্যবহার করা যায়। দৈনন্দিন জীবন থেকে একটি ছোট বিরতি; অর্থাৎ ৫ থেকে ১৫ মিনিট সময় নিয়ে, একাধিক উপায়ে অনুশীলন করা সম্ভব। অফিসে বসেই ধ্যান করতে পারেন এমন কয়েকটি উপায় এখানে রয়েছে-
১। শ্বাস গণনা/ ডীপ ব্রেথিং: গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে একটি সাধারণ ৫ মিনিটের শ্বাস গণনা ধ্যান সারা দিনের জন্য মনকে সতেজ করতে সাহায্য করতে পারে। এর জন্য আরামে বসতে হবে। চোখ বন্ধ করে ধীরেধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হবে। এটি চাপমুক্ত করার এবং স্বাচ্ছন্দ্যে ধ্যান করার সবচেয়ে সহজ উপায়গুলোর মধ্যে একটি।
২। মিউজিক মেডিটেশন: মিউজিক মেডিটেশন হল একটি ব্যতিক্রমী যৌথ বা ব্যক্তিগত ব্যায়াম যা অফিসে সহজেই করা সম্ভব। একসাথে সবাই বসে কিম্বা একা কানে হেডফোন দিয়ে কোনো একটি হালকা আরামদায়ক পিয়ানো/ বাঁশির সুর, ঝর্ণার ধ্বনি মৃদু ভলিউমে দিয়ে গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া যেতে পারে। এর জন্য কাজের ব্যাস্ততা বুঝে সময়সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। সবাই মিলে করলে এটি একটি যৌথ প্রশান্তি প্রদান করে যা কর্মক্ষেত্র জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। স্ট্রেস পরিচালনা করতে এবং ফোকাস উন্নত করতে এটি নিজেনিজেই প্রতিদিন স্বল্প সময়ের জন্য করা সম্ভব।
৩। প্রকৃতির সাথে ধ্যান: প্রকৃতির মন এবং আত্মাকে নিরাময়ের একটি আশ্চর্যজনক ক্ষমতা আছে। উদ্ভিদের উপস্থিতি, ইন্ডোর প্ল্যান্ট কাজের ডেস্কে, একজন ব্যক্তিকে ক্রমাগত শান্তিতে কাজ করতে সাহায্য করে। ধ্যান করার সময় কল্পনা করে নিতে পারেন যে, আপনি সবুজ প্রকৃতির ভেতর আছেন। এই কল্পনা আপনাকে পুনরুজ্জীবিত করবে।
কাজের বিরতিতে এখনই ছোট্ট পরিসরে চোখ বন্ধ করে একটু অনুশীলন করে নিতে পারেন। আগামীকাল নয়, শুরু করুন এখনই।
লেখকঃ ফারজানা ফাতেমা (রুমী)
মনোবিজ্ঞানী, “শৈশবকালীন প্রতিকূলতা ও নিউরো ইমেজিং স্টাডি বাংলাদেশ”, আইসিডিডিআর, বি। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি।