শফিকুল ইসলাম। এক সময় ছিলেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। বর্তমানে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠায় আগের প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে বাদ দেয় সরকার। তার স্থলে ২০১১ সালের নভেম্বরে নিয়োগ পান শফিকুল ইসলাম। অবসরে যাওয়ার পর ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর তাকে চুক্তিভিত্তিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে রেখে দেওয়া হয়।
এরপর আরও চার দফা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্মাণকাজের পুরোটা সম্পন্ন হয়েছে শফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে। বড় স্থাপনা নির্মাণে তার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সততার জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রশংসিত হয়েছেন। এজন্য পদ্মা সেতুর শেষ পর্যায়ে এসে সরকার নতুন কাউকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে চায়নি।
বাংলাদেশের স্বপ্নের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানান অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন শফিকুল ইসলাম। সেসব নিয়ে কথা বলেছেন তিনি:
*পদ্মা সেতুতে কোন ধরনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হবে?
শফিকুল ইসলাম: মানুষের জন্য সামাজিক যোগাযোগ দ্রুত হবে। মালামাল দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছাবে, ফলে দামও ভালো আসবে। অনেক মানুষ কম দামে পণ্য কিনতে পারবেন। ট্রাক স্বল্পসময়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারবে। এতে কৃষক দাম ভালো পাবেন, ভোক্তাও সতেজ পণ্য কিনতে পারবেন। নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধাও হবে। সেতু পাড়ে নানা ধরনের কলকারখানা হবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ। রাষ্ট্র ও মানুষ অনেক সুবিধা পাবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
*পদ্মা সেতুতে শুধু বিদেশি কোম্পানি কাজ করেনি। আমাদের অনেক দেশি কোম্পানিও কাজ করেছে। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?
শফিকুল ইসলাম: আমাদের তিনটি বড় কন্ট্রাক্ট ছিল পদ্মা সেতুতে। একটা মূল সেতু, একটা নদীশাসন ও অ্যাপ্রোচ সড়ক। মেইন ব্রিজে চায়নিজ ঠিকাদার, রিভার ড্রেজিংয়েও চায়নিজ ঠিকাদার সিনোহাইড্রো। অ্যাপ্রোচ সড়কে আবদুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল) ও মালয়েশিয়ার একটা কোম্পানি যৌথভাবে কাজ করেছে। আমাদের সক্ষমতা না থাকায়ই বিদেশি ঠিকাদার আনতে হয়েছে। তবে বিদেশি ঠিকাদারদের বলেছি তোমরা দেশি ম্যাটারিয়ালস ব্যবহার করবা। প্রকল্পে সিমেন্ট, বালি বাংলাদেশের। কিন্তু পাথর বাংলাদেশের ব্যবহার হয়নি, কারণ এই পাথর বাংলাদেশে নেই।
পৃথিবীতে বাণিজ্য হয় কেন? আমেরিকাও কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। চায়নাও প্রচুর ইমপোর্ট করে। যার যেটা সুবিধা আছে সেটা নিয়ে কাজ করেছি। রেলের কিছু প্লেট চীন থেকে এনেছি। আবার রেলওয়ের স্ট্রেনঞ্জার লুক্সেমবার্গ থেকে এনেছি। কারণ তারা এটা ভালো বানায়। আমরা ভারত থেকেও এটা আনিনি। কারণ এটা কোয়ালিটির প্রশ্ন। প্রকল্পে ভারত থেকে বেশি পাথর এনেছি, আবার দুবাই থেকেও পাথর এনেছি।
*পদ্মা সেতু প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল। বিশ্বব্যাংক চলে গেলো দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। নানা চড়াই-উতরাইয়ে ২৫ জুন সেতুর উদ্বোধন। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?
শফিকুল ইসলাম: যে কোনো কাজ করতে গেলে বিপদ-আপদ থাকবেই। প্রকল্পের শুরুতে যে সমস্যা ছিল, বিশ্বব্যাংক চলে গেলো, সেতু একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলো। তবে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী নেতৃত্বে সেই সংকট কেটে গেছে। আমাদের যথেষ্ট টাকা দিয়েছেন। ফিন্যান্সিয়াল কোনো প্রবলেম আমরা ফেস করিনি। পলিটিক্যাল ও সামাজিক কোনো প্রেশার আমরা ফেস করি না। সেতু বাস্তবায়নে কখনো টাকার অভাব ফেস করিনি। প্রকল্পের নিরাপত্তা সেনাবাহিনীকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে নিরাপদে আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছি।
দেশি ও বিদেশি লোকেরা প্রকল্প এলাকায় নির্বিঘ্নে কাজ করেছে। প্রকল্পে আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চমৎকার এনভায়রনমেন্ট পেয়েছি। প্রকল্প এলাকায় সাধারণ মানুষের চমৎকার সহযোগিতা পেয়েছি। যেখানে গেছি সবাই সহযোগিতা করেছে। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে এনবিআর সবাই আমাদের সহযোগিতা করেছে। এটা আমাদের প্লাস পয়েন্ট। কারণ পদ্মা সেতু আমাদের এমন একটা আবেগের জায়গা, এখানে সবাই আমাদের সহযোগিতা করেছে। সবাই পজিটিভ হিসেবে নিয়েছে, কেউ আমাদের না করেনি। এখানে বিরাট অ্যাডভান্টেজ পেয়েছি। অন্য প্রকল্পে হয়তো এই সুবিধা পাবে না।
*প্রকল্পে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে দেশি-বিদেশি নানান কোম্পানিকে সামলাতে হয়েছে। অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
শফিকুল ইসলাম: মানুষের জীবনে প্রতি পদে পদে অভিজ্ঞতা। বড় প্রকল্পে কাজ করে বড় অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রধানত আমরা হ্যান্ডেল করেছি বড় তিন ঠিকাদার ও পরামর্শক। ঠিকাদাররা আবার সাব-কন্ট্রাক্টে অনেক কাজ করেছে, এটা তারা সামলে নিয়েছে। আমরা সফলভাবে সবাই হ্যান্ডেল করেছি।
*পদ্মা সেতুতে হেঁটে পার হওয়া যাবে না। সাইকেল চালিয়েও পার হওয়া যাবে না। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?
শফিকুল ইসলাম: নিরাপত্তার জন্য কোনোভাবেই পদ্মা সেতু দিয়ে হেঁটে বা সাইকেলে পার হওয়া যাবে না। এতে সেতুর ওপর দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
*সেতুতে মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এই টাকা কতদিনে উঠবে?
শফিকুল ইসলাম: আমরা আশা করছি ২০ থেকে ২৫ বছরে টাকা উঠে আসবে। তবে এটা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। এমনও হতে পারে তার আগেই টাকা উঠে আসবে। আবার দেরিও হতে পারে। তবে ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে টাকা উঠে আসবে।
*টোল নিয়ে আপনার মতামত কী?
শফিকুল ইসলাম: পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাস ২০০০, ছোট বাস ১ হাজার ৪০০, মাঝারি ট্রাকে ২ হাজার ৮০০, মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০, পিকআপ ১ হাজার ২০০, কার/জিপ ৭৫০ ও মোটরসাইকেল আরোহীকে ১০০ টাকা টোল দিতে হবে। এটা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করেছে। আমাদের কাজ শুধু সেতু বানিয়ে দেওয়া।
*বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে অবকাঠামো উন্নয়নে নানান ভূমিকা রেখেছেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রায় সব বড় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। একইভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তিনি। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে তার অবদান ছিল সর্বজন স্বীকৃত। এ বিষয়ে যাদি কিছু বলতেন।
শফিকুল ইসলাম: স্যার (জামিলুর রেজা চৌধুরী) আমার শিক্ষক ছিলেন। স্যারের ছাত্র হতে পারাও কিন্তু সৌভাগ্যের। স্যার সরাসরি আমাদের ক্লাস নিয়েছেন। পদ্মা সেতুতে উনি ছিলেন আমাদের ফিলোসফার ও গাইড। যে কোনো সমস্যায় উনি নির্দ্বিধায় আমাদের সহযোগিতা করেছেন। ওনার মতো মেধাবী আমরা আর দেখিনি। ওনার স্মৃতিশক্তি প্রখর। স্যারের মতো ভদ্র মানুষ পাওয়া সৌভাগ্যের। উনি বিচিত্র গুণাবলির অধিকারী ছিলেন। স্যারের বিচিত্র গুণাবলি আমাদের প্রকল্পের কাজে লেগেছে।
স্যার ছিলেন সেতুর জন্য নিবেদিত প্রাণ। যখন স্যারের কাছে গিয়েছি তখনই স্যার আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্যারের গাইডেন্স প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্যতম পাথেয় ছিল। স্যারের মতো ইঞ্জিনিয়ার ক্ষণজন্মা এবং প্রতিভাবান লোকও বিরল। স্যার বাংলাদেশের একজন প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ছিলেন। ১৯২০ সালের ২৮ এপ্রিল স্যারকে আমরা হারিয়েছি। স্যার যদি বেঁচে থাকতেন তবে ২৫ জুন