ঘটনাটি বেশ কিছুদিন আগের। যেদিনের ঘটনা সেদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। স্বভাবতই ছুটির দিনগুলোতে বিকেলে খানিকটা বের হই। শীতের বিকেল, তাই তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। সে লদিন বেরোতে বেরোতেও খানিকটা সন্ধ্যে হয়ে গেল। গন্তব্য বাংলামটর।
বাসা থেকে রিকশার পথ হলেও যেতে প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামে পরতে হয়। সেদিন ভাগ্যক্রমে বাসার একগলি পার হয়েই রিকশা পেয়ে গেলাম। যেমনটা হবার কথা। কিছুদূর গিয়েই ট্রাফিক সিগন্যালে পড়তে হল। সিগন্যাল পার হয়ে আবার কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আবার সিগন্যালে পড়লাম।
হঠাৎ রিকশাচালক মামা পেছনে ঘুরে আমাকে বললেন- “আপা, একটা মোটর সাইকেল সেই পরথম থেইকা আমার রিকশা ফলো করতেসে। কয়েকবার ওভারটেক করতেও গেসে আর একদম চাকার সাথে বাইজা গাড়ি চালায় যাইতেছে।”
আমি বললাম” আপনি সিউর? এখনও আছে?” মামা বললেন- “আমি একটু আগে পিছনে ফিরতই হোন্ডা একটু দূরে নিয়া গেসে, আছে কিন্তু পিছনে।“ পুরো রাস্তায় আমি খানিকটা অন্যমনস্ক ছিলাম তাই খুব একটা খেয়াল করতে না পারলেও মামার কথায় হঠাৎ মনে পরল- আরে! তাই তো! রিকশায় উঠে কিছুদূর যাওয়ার পর একটা বাইকচালক বেশ কয়েকবার পেছন ঘুরে তাকাচ্ছিল।
কিন্তু এরপর আর খুব একটা মাথা ঘামাইনি। কারন এমনটা হরহামেশাই হয়। বাংলাদেশে এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন যার সাথে এমনটা ঘটেনি। যাই হোক, রিকশাচালক মামার কাছ থেকে কথাটা শুনে এবার ভালো করে খেয়াল করলাম। দেখলাম সেই প্রথম দেখা বাইকটাই। এখন আমার রিকশার চাকা ঘেঁষে না চালালেও একটু দূরে দিয়ে যাচ্ছে।
হেলমেট থাকায় বাইকচালকের মুখ বা মুখের পাশ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, শুধু হাল্কা গোলাপি রঙের জ্যাকেটটা ছাড়া। বাইকচালক একাই। তার সাথে অন্য কোনো আরোহী নেই। বাইকের নম্বর প্লেটটা পড়ার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু সম্ভব হয়নি কারণ চালক হয় আমার রিকশার পাশে নয়তো পেছন পেছন আসছিল।
এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার আছে তা আগেই বলেছি। স্কুল, কলেজ কিংবা কোচিং থেকে আসা যাওয়া করতে এমন বখাটের উৎপাত অনেক দেখেছি। এমনকি বাসা পর্যন্ত চিনে যেত কেউ কেউ! বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মেয়ের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আছে আমি নিশ্চিত। কিন্তু সে সময় আরও একটা ভয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, তা হল- ছিনতাই। আজকাল বাইকে করে ছিনতাই এর ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। চলন্ত বাইক থেকে আচমকা যাত্রীর ব্যাগ ধরে টান দেয় বা নির্জন রাস্তায় রিকশা থামিয়ে অস্রহাতে ভয় দেখিয়ে যাত্রীর কাছ থেকে সব কেড়ে নেয়।
এদিকে সন্ধ্যা একেবারেই নেমে গিয়েছিল। এখনো আরও বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দেওয়ার বাকি এবং এর মধ্যে একটা রাস্তাও পরবে খানিকটা নির্জন। আমি একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। একবার ভাবলাম নেমে পরবো কিনা। কি মনে করে এক বড় ভাইকে কল দিলাম, বললাম ব্যাপারটা। সে শুনেই সাথে সাথে আমাকে ৯৯৯ ইমারজেন্সি নম্বরে কল দিয়ে জানাতে বলল।
আমি এক মিনিট একটু ভাবলাম। চিন্তা করছিলাম, কি দরকার এইসব “পুলিশি ঝামেলা” করার! বাদ দেই। এমনতো কতই হয় কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল- আর কতো বাদ দিব? কতো এড়িয়ে যাব? না, এবার আর এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কোনও বিপদে পড়লে এই সময়টার জন্য আজীবন আফসোস করতে হবে।
দিয়েই দিলাম ৯৯৯ এ কল।
আগেই বলে রাখি এই নম্বরটি টোল ফ্রি। ডায়াল করলেই অটোম্যাটিকালি ইমারজেন্সি নম্বর লেখাটি আপনার ফোনে ভেসে উঠবে। ফোনে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স না থাকলেও কল করা যায়। যদিও ঘটনার সময় আমার ফোনে ব্যালেন্স ছিল। যাই হোক, কিছুক্ষণ রিং করার পর ওপাশ থেকে একজন পুলিশ অফিসার ফোন রিসিভ করলেন।
আমি তাকে ঘটনা খুলে বলতেই আমার নাম এবং ঐ মুহূর্তে ঠিক কোথায় আছি এবং জায়গাটি কোন থানার অন্তর্ভুক্ত জানতে চাইলেন। আমি সব বললাম এবং এটাও জানালাম যে কিছুটা সামনেই একটা সিগন্যাল পয়েন্ট আছে। অফিসার তৎক্ষণাৎ বললেন একটু পরই আপনার কাছে সাহায্য পৌঁছে যাবে। আপনি আপনার নম্বরটি একটিভ রাখুন।
পুলিশ অফিসার এর সাথে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় মিনিট কথা হয়েছে, কল কেটে দিতেই কয়েক সেকেন্ড পর একটি মোবাইল নম্বর থেকে কল আসে। এবার অন্য একজন পুলিশ অফিসার। তিনি আমার অভিযোগের কথা জানতে চেয়ে বললেন আপনি আপনার সামনের সিগন্যাল পয়েন্টে নেমে পরুন, আমরা এখুনি আসছি।
এর মধ্যে রিকশাচালক মামাকে বলেছিলাম বাইকটি ফলো করতে। বাইকটি পিছনে থাকলেও ছিল বেশ খানিকটা দূরে। আমি পুলিশের কথামতো রিকশা থামিয়ে রিকশায় বসে রইলাম। মিনিট দুইয়ের ভেতরই আমার রিকশার পিছনে পুলিশের একটি জিপ এসে থামল এবং এর মধ্যেই আগের নম্বরটি থেকে কল আসছিল। কল রিসিভ করতেই বলল- আপনাকে আমরা দেখেছি, আপনি রিকশা থেকে নামুন।
আমি রিকশা থেকে নেমে দেখি তিন জন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। একজনের হাতে বড় মোটা লাঠি। আমি কাছে যেতেই জান্তে চাইলেন, বাইকটি এখন কোথায় আছে? ঐ মুহূর্তের ঘটনার আকস্মিকতায় কিনা জানি না, আমি বা রিকশাচালক দুই-তিন মিনিটের জন্য বাইকটি দেখে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। এরই মধ্যে আবার সিগন্যালও ছেড়ে দেয়। বুঝতে পারছিলাম না ঠিক বাইকটা পিছনে আছে, নাকি আমাকে নামতে দেখে বা পুলিশের সাথে দেখে পালিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন বাইকটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন অফিসার বললেন- চলেন, আমরা পিছনের দিকে যাই।
বেশ অনেকটা দূর পিছিয়ে গেলাম। পথিমধ্যে যতগুলো বাইক পরেছে সবগুলো দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল যে এটা কিনা, ওটা কিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ বাইকটি আমি খুঁজে পেলাম না। তাছাড়া এত অল্প সময় দেখে বাইকটি শনাক্ত করাটাও ছিল বেশ মুশকিল। বাইকটি খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে গেলাম।
অফিসাররাও বার বার বলছিলেন যে, ঐ বেটার ভাগ্য ভালো তা না হলে আজকে ধরতে পারলে ‘ফলো’ করা বুঝিয়ে দিতাম। উনারাও বলছিলেন সম্ভবত আমাদের দেখেই বেটা পালিয়েছে। ততোক্ষণে আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে এলাম।
আমি অফিসারদের কাছে খুব দুঃখ প্রকাশ করলাম, বাইকটি শনাক্ত করতে না পেরে। কিন্তু অফিসাররা উল্টো আমাকে খুব করে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন, কল করে এমন একটা পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। বার বার অফিসাররা বলছিলেন- ‘পাওয়াটা ভাগ্যে ছিল না, এটা ব্যাপার না। কিন্তু আপনি যে অনিরাপদবোধ থেকে কল করে বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন এর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। যেকোনো একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতেই পারত, কিন্তু সেটা ঘটার আগেই আপনি সাবধান হয়েছেন।’
আমি আর না পেরে বলেই ফেললাম “আমি এত দ্রুত সাহায্য আশা করিনি!” অফিসার হেসে বললেন “আমরা আপনাদের আশেপাশেই থাকি। যেকোনো ধরনের সাহায্যে একটা কলের সাথে সাথেই আমাদের পাবেন।“ এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি একা যেতে পারবো কিনা। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, পারবো কোনো সমস্যা নেই। কারণ ইতোমধ্যে ভয় কেটে গেছে। তারপরও বার বার বললেন যে, কোনও ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখলে যেন সাথে সাথে কল করে জানাই।
এরপর কোনো অস্বাভাবিকতা, দুর্ঘটনা ছাড়াই গন্তব্যস্থলে পৌছাই। পৌঁছানোর কিছু সময় পর পুলিশ অফিসারের নম্বর থেকে আবার কল আসল। জানতে চাইলেন, ঠিকমতো পৌঁছুতে পেরেছি কিনা। ফোন কাটার আগে আবার বললেন, কখনো কোনোও ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখলে বা সম্ভাব্য দুর্ঘটনার কবলে পরলে যেনো অবশ্যই জানাই। আমার করা অভিযোগের পর সাহায্য গিয়েছিল কিনা এবং সাহায্য পেয়েছি কিনা জানতে চেয়ে কিছুক্ষণ পর ৯৯৯ ইমারজেন্সি নম্বর থেকেও কল আসে।
খুব ছোট্ট একটি ঘটনা কিন্তু চমৎকার অভিজ্ঞতা! আমরা প্রায়শই এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয় এবং সুন্দর করে এড়িয়েও যাই। আমিও এড়িয়ে যাই মাঝে মাঝে রাস্তায় ইভটিজিং এর, টুকটাক কিছু প্রতিবাদ করা ছাড়া। কিন্তু আর কতদিন এভাবে আমরা এড়িয়ে যাব? দেখেও না দেখার ভান ধরব?
আমি হয়তো ঐদিন কোনো দুর্ঘটনার শিকার হইনি, কিন্তু হতেই তো পারতাম। আমার ব্যাগ ছিনতাই হতে পারত, রাস্তায় পরে গিয়ে রক্তাক্ত হতে পারতাম এবং আরও বীভৎস কিছু হতে পারত যা চিন্তা করেই আমি আতঙ্কিত। অথচ এ ধরনের কতো ছোট ছোট এড়িয়ে চলে যাওয়ার মতো ঘটনা কতো বড় বড় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত ঘটায় আমরা কি তা কখনো ভেবে দেখেছি? আমার মনে হয় ভাবা প্রয়োজন। আর নয় এড়িয়ে যাওয়া, এখন সময় সচেতনতার।
সরকার এই ইমারজেন্সি নম্বরটিকে ব্যাবহারে জনগণকে সচেতন করার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। এখন আশেপাশে ঘটতে থাকা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানানোর দায়িত্ব আমাদের। আসুন আমরা নিজেরা সচেতন হই এবং অপরকেও সচেতন হতে সাহায্য করি।
সৈয়দা তাহ্সিনা হৃদিতা
যুব উপদেষ্টা, জাতিসংঘ যুব উপদেষ্টা পরিষদ।