‘আমি কাজ করে আনন্দ পাই। কাজকে উপভোগ করি। আমার এখানে অনেক সময় গভীর রাতেও রোগী আসেন। আমি তাদের সার্বক্ষণিক সেবা দেই। তাদের যে ভালোবাসা এবং দোয়া পাই তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি মনে করি আমার অবস্থান থেকে মানুষের জন্য কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। আমি চাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন মানুষের সেবা করে যেতে পারি।’
শুক্রবার (১৯ মে) সকালে আলাপকালে এইভাবে কথাগুলো বলছিলেন ৮ হাজার নরমাল ডেলিভারি করানো হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নূরজাহান বেগম।
নূরজাহান বেগম বছরে প্রায় হাজারটি নরমাল ডেলিভারি করেন। টানা ১৯ বছর ধরে জেলায় হয়েছেন শ্রেষ্ঠ। আর সিলেট বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন ৭ বার। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন দেশসেরা পুরস্কারও। শুধু গ্রাম নয়, শহরের মানুষের মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে নূরজাহান বেগমের নাম।
গত ২৯ বছর ধরে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা হিসেবে চাকরি করছেন নূরজাহান বেগম। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আছেন ২৬ বছর ধরে। এর আগে ৩ বছর চাকরি করেছেন নবীগঞ্জ উপজেলার বড় ভাকৈর ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। নিজের ইউনিয়নের বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকেও গর্ভবতী নারীরা নরমাল ডেলিভারি করাতে ছুটে আসেন তার কাছে।
নূরজাহান বেগমের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের কররা গ্রামে। স্বামী মো. নূর উদ্দিন চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী। অসুস্থ থাকায় ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে জাকারিয়া চৌধুরী নাঈম সাইপ্রাসে বিবিএ পড়ছেন। ছোট ছেলে শাহরিয়ার চৌধুরী নাদিম মায়ের পথ ধরেই হাঁটছেন। পড়ছেন মৌলভীবাজার মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কলেজে।
নূরজাহান বেগম জানান, তিনি এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছেন গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ায়। পরবর্তীতে সিলেট ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে দেড় বছর মেয়াদী কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৯৪ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরি জীবনে কমপক্ষে ৮ হাজার নরমাল ডেলিভারি করেছেন। বছরে কমপক্ষে ১ হাজার নরমাল ডেলিভারি করেন তিনি। গত ১ বছরে তার কেন্দ্রে ৯১৮টি নরমাল ডেলিভারি করেছেন। এর মধ্যে একই সময়ে একসঙ্গে ৩টি করে সন্তান প্রসব করেছেন তিনজন প্রসূতি। আর প্রতি মাসে কমপক্ষে ২-৩টি যমজ সন্তান প্রসব হয় তার কেন্দ্রে।
নূরজাহান বেগমের কাছে সেবা নিতে আসা শাহেনা বেগম জানান, তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে পইল ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। নরমাল ডেলিভারি হয়েছিল।
শাহেনা বেগম বলেন, ‘আমরা এখানে এসে শান্তি পাই। হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকে গেলেই সিজার করাতে হয়। এতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। যা আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। নূরজাহান আপা আমাদের নরমাল ডেলিভারি করে দেন।’
পইল গ্রামের জাকির হোসেনের স্ত্রী সাহানা আক্তার বলেন, আমার তিন সন্তান নূরজাহান বেগমের কাছে নরমাল ডেলিভারিতে জন্ম নিয়েছে। শুধু আমি না, এ এলাকার প্রায় সব প্রসূতিরই এখানে নরমাল ডেলিভারি হয়। চুনারুঘাট, বাহুবল, লাখাই, বানিয়াচংসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গর্ভবতী নারীরা নরমাল ডেলিভারির জন্য এখানে ছুটে আসেন।’
জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক মীর সাজেদুর রহমান বলেন, ‘পইল স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে অনুস্বরণ করে আরও বিভিন্ন কেন্দ্রে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এর একটি ভালো দিক হলো সারা দেশে যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো আছে তার মধ্যে প্রতি মাসে শীর্ষ ১০ এর তালিকা তৈরি করা হয়। সেখানে প্রতি মাসেই হবিগঞ্জের ২-৩টি কেন্দ্র স্থান পায়। এছাড়াও শীর্ষ ৩০ এর তালিকাও হয়। এ তালিকায়ও কমপক্ষে ৫টি থাকে। সারা দেশে ৩০টির মাঝে যে ৫টি হবিগঞ্জেরই থাকে এটি আমাদের জন্য অনেক গর্বের। আমরা আশা করি একজন আরেকজনকে দেখে অনুকরণ করতে গিয়ে এক সময় দেখা যাবে শীর্ষ ৩০ এর ১৫টাই আমরা অর্জন করবো। আর এ অর্জনটাই শুধু বড় কথা নয়, এক সময় এ সেবাটা সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৪ সাল থেকে টানা ১৯ বছর ধরে নূরজাহান বেগম জেলায় শ্রেষ্ঠ পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা হয়ে আসছেন। সিলেট বিভাগে প্রথম হয়েছেন ৭ বার। ২০১৯ সালে তিনি সারা দেশে প্রথম শুদ্ধাচার পুরস্কার পান। সিলেট বিভাগে এর আগে আর কেউ এ পুরস্কার পায়নি।