ইউরোপের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভক্সওয়াগন জার্মানির ড্রেসডেন কারখানায় গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করতে যাচ্ছে। আগামীকাল মঙ্গলবারের (১৬ ডিসেম্বর) পর সেখানে আর কোনো গাড়ি তৈরি হবে না। এর মধ্য দিয়ে ৮৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জার্মানিতে কোনো উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ করল প্রতিষ্ঠানটি।
চীনে বিক্রি কমে যাওয়া, ইউরোপে চাহিদা দুর্বল থাকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির চাপ—এই তিন কারণে ভক্সওয়াগনের নগদ প্রবাহ (ক্যাশ ফ্লো) চাপে পড়েছে। এরই অংশ হিসেবে ড্রেসডেন কারখানার উৎপাদন লাইন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভক্সওয়াগন আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করলেও কোন খাতে কত বিনিয়োগ হবে, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছুদিন ধরেই সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে পেট্রোলচালিত গাড়ির ব্যবহার প্রত্যাশার চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলবে—এমন ধারণা তৈরি হওয়ায় ওই খাতে নতুন করে বিনিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভক্সওয়াগনের এই বিনিয়োগ বাজেট প্রতিবছর হালনাগাদ করা হয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কমানো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৩ থেকে ২০২৭ মেয়াদে বিনিয়োগ পরিকল্পনার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ইউরো।
গত অক্টোবরে ভক্সওয়াগনের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা আরনো আন্টলিট্জ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ২০২৫ সালে কোম্পানিটির নিট ক্যাশ ফ্লো শূন্যের কাছাকাছি থাকার যে পূর্বাভাস ছিল, তা হয়তো সামান্য ইতিবাচক হতে পারে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এরপরও কোম্পানিটি চাপের মধ্যেই থাকবে।
বার্নস্টাইনের বিশ্লেষক স্টিফেন রাইটম্যান বলেন, “২০২৬ সালে ক্যাশ ফ্লোর ওপর চাপ স্পষ্টভাবেই থাকবে।” তার মতে, খরচ কমানো এবং পরিচালন মুনাফা বাড়ানোর নানা পথ খুঁজছে ভক্সওয়াগন।
রাইটম্যান আরও বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল দীর্ঘায়িত হওয়ায় নতুন প্রজন্মের পেট্রোল প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, যা কোম্পানির জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। “নতুন ধরনের গ্যাসোলিন প্রযুক্তির দিকে তাকাতে হচ্ছে,” বলেন তিনি।
ইউনিয়ন ইনভেস্টমেন্টের পোর্টফোলিও ম্যানেজার মরিট্জ ক্রোনেনবার্গার বলেন, ভক্সওয়াগনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে কিছু প্রকল্প বাদ দিতেই হবে। তার ভাষায়, “নির্ধারিত বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে অন্য অনেক ধারণা ও প্রকল্প পরিকল্পনা থেকে সরিয়ে নিতে হবে।”
২০০২ সালে উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে ড্রেসডেন কারখানায় মোট ২ লাখেরও কম গাড়ি তৈরি হয়েছে। যা ভক্সওয়াগনের প্রধান কারখানা ভলফসবুর্গে এক বছরের উৎপাদনের অর্ধেকেরও কম।
এই সিদ্ধান্ত জার্মানিতে ভক্সওয়াগনের উৎপাদন সক্ষমতা কমানোর পরিকল্পনায় একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গত বছর শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে হওয়া এক চুক্তির অংশ হিসেবেই এসব পরিবর্তন আসছে, যার ফলে জার্মানিতে ভক্সওয়াগন ব্র্যান্ডের অধীনে প্রায় ৩৫ হাজার কর্মসংস্থান কমে যাবে।
ভক্সওয়াগনের ব্র্যান্ডপ্রধান থমাস শ্যাফার চলতি মাসে বলেন, ড্রেসডেন কারখানায় উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত “হালকাভাবে নেওয়া হয়নি।” তবে তার মতে, “অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল অপরিহার্য।”
ড্রেসডেন কারখানাটি একসময় ভক্সওয়াগনের প্রকৌশল সক্ষমতার প্রদর্শনী কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এখানে প্রথমে উচ্চমূল্যের ভক্সওয়াগন ফাইটন মডেলের গাড়ি সংযোজন করা হতো। ২০১৬ সালে ফাইটন উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর কারখানাটি ভক্সওয়াগনের বৈদ্যুতিক গাড়ি উদ্যোগের প্রতীক হয়ে ওঠে। সর্বশেষ এখানে ব্যাটারিচালিত আইডি.৩ মডেলের গাড়ি তৈরি হচ্ছিল।
উৎপাদন বন্ধ হলেও ড্রেসডেন কারখানাটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হচ্ছে না। এটি ড্রেসডেন টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিকে ভাড়া দেওয়া হবে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিক্স ও চিপ প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য একটি গবেষণা ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হবে।
এই প্রকল্পে আগামী সাত বছরে ভক্সওয়াগন ও বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে ৫০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। একই সঙ্গে ভক্সওয়াগন জানিয়েছে, গ্রাহকদের কাছে গাড়ি হস্তান্তর এবং পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে ভবনটি ভবিষ্যতেও ব্যবহার করা হবে।
সূত্র: ফিনান্সিয়ার টাইমস