২০২২ সালে দেশে ৬৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৭১৩ জন নিহত এবং ১২,৬১৫ জন আহত হয়েছেন। এই সময়ে ২৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩০৯১ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ৪০.০৭ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৬২৭ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১.০৯ শতাংশ। শনিবার (৭ জানুয়ারি) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
৯ টি জাতীয় দৈনিক, ৭ টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্টনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে সংস্থাটির তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়ঃ দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২৫৯৬টি (৩৮%) জাতীয় মহাসড়কে এবং ২২০৫টি (৩২.২৮%) আঞ্চলিক সড়কে। দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ড্রামট্রাক ২৫.৪০ শতাংশ। সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে সকালে ২০৩৩টি (২৯.৭৭%)।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছেঃ ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে (১৮৪১ টি দুর্ঘটনায় নিহত ২০৪৪ জন)। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে (৩১৩ টি দুর্ঘটনায় নিহত ৩৭৫ জন)। ওদিকে, সারা দেশে ৮২ শতাংশ রেল ক্রসিং অরক্ষিত। গত বছরে এসব রেল ক্রসিংয়ে ৫১টি দুর্ঘটনায় ৭৯ জন নিহত হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা জানাচ্ছেঃ গত ৪ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মাত্রা সর্বোচ্চ। ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ এই ৪ বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় সমান। খুব কম-বেশি হয়নি। মূলত ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণেই ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীতে ২৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৬ জন নিহত এবং ২২৭ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে পথচারী ৬০.৫৩%।
সংবাদ সম্মেলনে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। সংস্থাটির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী (লিগ্যাল ইকোনোমিস্ট), নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট তারিক চয়ন ছাড়াও অন্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এর মতে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ: ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এর সুপারিশসমূহ: ১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে; ১০. “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংস্থাটি বলছেঃ ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার ৪৬ কোটি টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, সেজন্য এই হিসাবের সাথে আরও ৩০% যোগ করতে হবে। iRAP (International Road Assessment Program) এর method অনুযায়ী হিসাবটি করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ যানবাহন বা প্রপার্টি ড্যামেজ হয়েছে তার তথ্য না পাওয়ার কারণে প্রপার্টি ড্যামেজের আর্থিক পরিমাপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। গণমাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে ৩/৪ গুণ বেশি। এই বিবেচনায় এবছর সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ জিডিপি’র ১.৫ শতাংশের বেশি হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি “ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড” গঠনের দাবি জানায় যার মাধ্যমে দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার তাৎক্ষণিক পরেই আহতদের চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব বলে মনে করে সংস্থাটি। সেইসাথে মোটরযানের “তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবীমা” কার্যকরভাবে ফেরতের দাবি জানানো হয়।