বিশ্ব আজ করোনায় জর্জরিত। এই ভাইরাস আমাদের গতিময় ও ব্যস্ত জীবনকে থমকে দিয়েছে। আমরা আবদ্ধ নিজের ঘরে- যার বর্তমান নাম হোম কোয়ারেন্টাইন। হয়তো সীমানার দিক থেকে ঘরটি বাইরের জগত এর তুলনায় অনেক ছোট কিন্তু আপনার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ও ঘরের ভেতরের কাজের ভিন্নতা এই ছোট্ট ঘরের সীমানাকে অনেক বড় করে তুলতে পারে।
মনো-দৈহিক কাজের (Psycho-Motor Activity) মাধ্যমে আপনি হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে পারেন।
ব্যস্ততার জন্য এতোদিন যে কাজগুলো আপনি করতে পারেননি তা হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় করতে পারেন। যেমন- বিভিন্ন ফুল,ফল,পাতাবাহার ও ওষধি গাছের চারা রোপন করে নিজ ঘরের বারান্দায় বাগান করতে পারেন। এলোমেলো জিনিসগুলোকে গুছিয়ে এবং আসবাবপত্রের অবস্থান পরিবর্তন করে ঘরের নতুনত্ব তৈরি করতে পারেন। সন্তানের কথা ধৈর্য্য সহকারে শুনে তার সাথে গল্প করতে পারেন। লুডু ও দাবা খেলতে পারেন তাদের সাথে। মোবাইল ও ট্যাবে গেমস এপস ব্যবহার করেও তার সাথে সীমিত সময়ের জন্য খেলতে পারেন (তবে সন্তান যেনো মোবাইল ও ট্যাব ব্যবহারে আসক্ত হয়ে না পরে সেদিকে নজর রাখা বাঞ্ছনীয়)।
পরিবারের সদস্যদের সাথে মুখোমুখি অথবা মেসেঞ্জারে, হোয়াটসএপ, ভাইবারে কথা বলতে পারেন বা তাদেরকে ভিডিও কল দিতে পারেন। নিজের পছন্দের বই পড়তে পারেন,পছন্দের গান শুনতে পারেন,পছন্দের সিনেমা দেখতে পারেন এবং মজার রান্না করে পরিবারের সবাইকে নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ানোর মাধ্যমেও আপনি ঘরের ভেতর বদ্ধ এ সময়কে উপভোগ্য করে তুলতে পারেন।
আপনার সুপ্তগুণগুলো যেগুলোকে খুব কমই পরিচর্যা করার সুযোগ পেয়েছেন, হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় সে সুপ্ত গুণগুলোর চর্চা আবার শুরু করতে পারেন। যেমন-একসময় চমৎকার গান গাইতে পারতেন,বহুকাল গানের চর্চা করতে পারেননি- আপনি এখন এ সময় ঘরে বসে খালি গলায় বা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার চর্চা আবার শুরু করতে পারেন। নাচ হয়তোবা শিখেছিলেন, বাসায় বসে মিউজিকের সাথে নাচের চর্চা আবারো শুরু করতে পারেন। চমৎকারভাবে আবৃত্তি করতেন এক সময় হয়তোবা, ঘরে বসে আবৃত্তি চর্চা আবারো শুরু করতে পারেন।
কবিতা,ছড়া,গান,কাব্য,উপন্যাস লেখার চর্চাও আবার শুরু করতে পারেন। ছবি আঁকতে হয়তোবা কখনো ভালবাসতেন- এ সময় আবারো আকাআকি শুরু করতে পারেন। বাড়ির দেয়াল বা মেঝেতে আলপনা আঁকতেন হয়তোবা, তা আবারো ঘরে বসে এ সময়ে করতে পারেন। কেউবা এসময় জামা,শাড়ি বা নকশিকাথা সেলাই করতে পারেন।
নিজের প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল হবার এখনই সবচে ভালো সময়। যেমন- ঘরে বসে মেনিকিউর,পেডিকিউর,ফেসিয়াল করতে পারেন। ঘরে বসে চুলে তেল দিতে পারেন,হেয়ার স্পা করতে পারেন। হাল্কা ব্যায়াম করতে পারেন। নির্দিষ্ট সময় ধরে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে হাঁটতে পারেন। সুন্দরকরে সেজে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ফটোসেশন করতে পারেন।
কিছু ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন করতে পারেন হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থায়। যেমন-মাইক্রোসফট ওয়ার্ড,এক্সেল,পাওয়ার পয়েন্ট কাজ করা শিখতে পারেন পরিবারের অপর কোন সদস্যের কাছ থেকে। স্মার্ট মোবাইলের বিভিন্ন ফাংশন শিখতে পারেন। অর্থাৎ একজন দক্ষ অনলাইন ইউজার হয়ে উঠতে পারেন এসময়ে।
ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন। নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করাসহ নিজ নিজ ধর্মের ধর্মীয় কাজগুলোতে মনযোগী হতে পারেন।
সারাক্ষণ ধরে টিভি বা অনলাইনে করোনা সংক্রান্ত খবর দেখবেন না বা শুনবেন না, ভাববেন না বা আলোচনা করবেন না যা আপনার মস্তিষ্কে গেথে যাবে, আপনাকে আতংকিত করে তুলবে এবং হোম-কোয়ারেইন্টাইন জীবনকে একঘেয়েমিতে পরিণত করবে।
উল্লিখিত সমস্ত কাজগুলোকে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন যে প্রতিটি কাজেই রয়েছে আপনার নিজস্ব চিন্তা বা পছন্দ (Psycho) এবং তা বাস্তবায়ন করতে আপনাকে নিজ দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে নড়াচড়া (motor) করাতে হবে। এভাবে মনো-দৈহিক (psycho-motor) কাজের মাধ্যমে আপনি ইতিবাচক চিন্তা (positive thinking) এবং ইতিবাচক শারীরিক কাজ (positive motor activity) করবেন যা আপনাকে মানসিক আর শারীরিকভাবে সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে। কেননা ইতিবাচক চিন্তা ও কাজ আপনার স্নায়বিক প্রক্রিয়া (Neural Transmission System), হরমোনের নিঃস্বরণ (Hormonal Secretion) এবং রক্তচাপ (Blood Pressure) কে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ইতিবাচক মনো-দৈহিক আচরণ (positive psycho motor behavior) আপনাকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে কেন্দ্র করে আতঙ্কিত হতে দেবে না।
আপনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় বিষন্নতা,হতাশা,অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে শিখবেন। হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় থেকেও আপনি হবেন আত্মবিশ্বাসী ও নিজ আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী – যা আপনাকে উন্নত ব্যক্তিত্বের এক নতুন “আমি” – এর সাথে পরিচয় করাবে।
লেখক- মুনিরা আজহার ঊর্মী
সহকারি অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।