বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল হাজার কোটি টাকা দুবাইয়ে পাচার করেছেন। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁর স্ত্রী তথা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও শ্যালিকা সাবরিনা নাসরিন।
আদালত কর্তৃক গঠিত ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক গতকাল মঙ্গলবার এই মন্তব্য করেছেন। তবে তিনি জানান, টাকার সুনির্দিষ্ট পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা যায়নি। ইভ্যালির বর্তমান অবস্থা, দায়দেনা, সম্পদের পরিমাণ নিরীক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ১৫ দিনের মধ্যে তা নিরীক্ষকের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
ইভ্যালির বর্তমান অবস্থা, দায়দেনা, সম্পদের পরিমাণ, পরিচালনার প্রক্রিয়া, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গত ১৮ অক্টোবর আদালত ইভ্যালির ব্যবস্থাপনার জন্য এই কমিটি গঠন করে। ইভ্যালির টাকা উদ্ধারে কাজ করবে এই কমিটি।
গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ইভ্যালির কার্যালয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। এতে বোর্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন, অন্য সদস্য স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ রেজাউল আহসান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফখরুদ্দিন আহম্মেদ ও কম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে বিচারপতি মানিক বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে। আমাদের তদন্তকাজে সফল হতে এগুলো কাজে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘এখানে দুটি সিন্দুক ও কয়েকটি আলমারির সন্ধান পেয়েছি। তালাবদ্ধ এই সিন্ধুকগুলোতে অনেক মূল্যবান সম্পদ রয়েছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।’
ইভ্যালির বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘এখানে জনগণ হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে। প্রতারিত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। তাদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া আমাদের আইনি দায়িত্ব। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করব জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, ইভ্যালির প্রত্যেক কর্মীর কাছে একটি করে ল্যাপটপ ছিল; তারা এসব ল্যাপটপ নিয়ে চলে গেছে। সেগুলো উদ্ধার করা হবে। কারণ এগুলো ইভ্যালির সম্পদ। এর বাইরে অনেক সম্পদ আছে; সেসব সম্পদ উদ্ধার করব। চেকের একটি লিস্ট পেয়েছি। এগুলো যাদের কাছে আছে, তাদের ডাকব। যদি না আসে, প্রয়োজনে যেভাবে আসে, সেভাবে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
রাসেল প্রতি মাসে দুবাই যেতেন উল্লেখ করে মানিক বলেন, ‘বাড়ির মালিক সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, রাসেল বিপুল পরিমাণ টাকা দুবাইয়ে পাচার করেছে। এর সঙ্গে তার স্ত্রী নাসরিন ও শ্যালিকা সাবরিনা নাসরিন জড়িত। তাদের নিয়ে সে দুবাই যেত। এটি আমাদের জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য।’
অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাগমন্টের মাধ্যমে পাচার করা টাকা ফেরত আনা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অ্যাগমন্টের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য থেকে তারেক রহমান ও কোকোর টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ২০ হাজার পাউন্ড ইংল্যান্ডে নেটওয়েস্ট ব্যাংকে জমা হয়েছে—এ তথ্য পাওয়া গেছে। যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ৫০ হাজার কোটি টাকা জমা আছে সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর সরকারই এই খবর জানিয়েছে। এই গ্রুপের মাধ্যমে ইভ্যালির টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে।’
জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলতে দেওয়া যাবে না মন্তব্য করে বিচারপতি মানিক বলেন, ‘আইনে দেওয়া সব ক্ষমতা প্রয়োগ করব টাকা উদ্ধারে। যত দূর যাওয়া দরকার জনগণের অধিকার আদায়ে তত দূর যাব। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে নয়, জনগণের দায়িত্ব নির্বিঘ্নে পালন করব।’
টাকা পাচারে রাসেলের শ্যালিকা সাবরিনা নাসরিন জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনো তিনি ষড়যন্ত্র করছেন তাঁদের হাতে ইভ্যালি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। প্রতারণা করে টাকা মেরে দেওয়া তাঁদের হাতে ইভ্যালি ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে তাঁদের কাছে অনেক তথ্য রয়েছে; চেক বই আছে। শিগগিরই জেল কর্তৃপক্ষের মাধমে এই চেক বই ফেরত চাওয়া হবে। প্রয়োজনে মামলা করা হবে।
ইভ্যালির অফিস ব্যবস্থাপনা কমিটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখান থেকে কেউ কোনো কিছু নিতে পারবে না। আদালতের নির্দেশনা অনুসারে ইভ্যালির ভোক্তাদের দায়দেনা ছয় মাসের মধ্যে কেউ চাইতে পারবে না।’
প্রসঙ্গত, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুন মাসে ইভ্যালির ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে উঠে আসে ইভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলায় বর্তমানে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন কারাগারে রয়েছেন।