চারদিকে আলুসহ হরেক রকমের ফসলের ক্ষেত। আলু ক্ষেতের মাঝখানে এক-আধটা সরিষা গাছ। ফুল-পাতায় রাতের জমা শিশির এখনও শুকায়নি। এরিমধ্যে চরের ক্ষেতে কাজে নেমে পড়েছেন সব বয়েসি নারী-পুরুষরা। তিস্তার ধু ধু বালু প্রান্তরে সবুজের সমারোহ। সেই তিস্তা, যার সবকিছু কেড়ে নেওয়ার সর্বগ্রাসী ভয়ে দিন পার করেন এসব মানুষ। বাকি অর্ধেকটা সময় পরিবারসুদ্ধ ঘাম-শক্তি আর মমত্ব দিয়ে বালু-ভেদে অঙ্কুরিত করেন নানান জাতের দেশি ও বিদেশি ফসল। চকচকে বালুকে পরিণত করেন সবুজের জীবন্ত কার্পেট।
এসব কৃষকের নেই নির্দিষ্ট জমির সীমানা। এবছর এই দিকে তো ওই বছর ওই দিকে। কোনও মৌসুমে কারও জমি জেগে ওঠে, আবার কারোটা ভাঙনের কারণে অদৃশ্য হয়। একবার জমির মালিক, অন্যবার বর্গাচাষি অথবা দিনমজুর। তবুও যুগের পর যুগ বাবা-দাদার দেখানো চাষপদ্ধতি অবলম্বন করছেন তারা। ফলাচ্ছেন তরমুজ, মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, আলু, বাদাম, পেঁয়াজ, গম, সরিষা, তামাক ছাড়াও সবজি ও মসলাজাতীয় ফসল। বাদ যায়নি একটু পলি জমা জমিতে বোরো চাষও।
কৃষি দপ্তর জানাচ্ছে, লালমনিরহাটে চরকেন্দ্রিক ৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ভুট্টার পরিমাণ সব থেকে বেশি।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, গেলো বছর মিষ্টি কুমড়া চাষে বিঘাপ্রতি ৬০ হাজার টাকা করেছে কৃষকরা। ভুট্টা বিঘায় ৫০ মণ পর্যন্ত হচ্ছে। আর আলু হচ্ছে ১২০ মণের বেশি। এবার আগাম জাতের ফসল চাষে ভারি হচ্ছে কৃষকদের আয়ের অঙ্ক। সাফল্য দেখিয়েছেন চিয়াসিডসহ সব রকম দেশি-বিদেশি ফসল চাষে।
এরিমধ্যে গত দুই বছরে জেলায় পোল্ট্রি ফিডসহ বেশকিছু বহুজাতিক কোম্পানি তাদের ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চরে উৎপাদিত ফসলের বাজারমূল্য ৪০০ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে ছোট ছোট জমিতে চাষকৃত ফসল তো রয়েছেই। তাদের ধারণা, সঠিক ও পরিকল্পিত নজরদারিতে লালমনিরহাটের চরের উৎপাদিত ফসল হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এই প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় চর দিনকে দিন বেহাত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে সড়ক, অপরিকল্পিত বাজারঘাট, বাড়ি, প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। চরের জীববৈচিত্র ধ্বংসের নির্মমতায় অনেকটা স্থবির হতে চলেছে নদীর প্রাকৃতিক রূপ। দেখা গেছে, ইন্ট্রাকো সোলার লিমিটেডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নদীর গতিপথ পাল্টিয়ে দিয়েছে। নিজেদের ইচ্ছেমত করেছে ব্রিজ-কালভার্ট। এমন ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও চরের কৃষকরা শুধুমাত্র কৃষি পরামর্শ বা চরকেন্দ্রীক আধুনিক কৃষির দাবি তুলেছেন।
এসব চরাঞ্চলের কৃষি নিয়ে কথা হয় কৃষক, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে।
কৃষকরা জানাচ্ছেন, তারা নিজেদের ইচ্ছেমত চাষাবাদ করছেন। আদিকালের চাষপদ্ধতি-ই তাদের ভরসা। কৃষি কর্মকর্তা বা কোনও পরামর্শক তাদের নেই। সঠিক পরামর্শ-সেবা পেলে তাদের উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, তার উপজেলায় ৬টি চরাঞ্চলে ৩৭০০ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ ভাগ জমি এবার চাষের আওতায় এনেছেন।
আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ওমর ফারুক বলছেন, চর একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা। এখানে সব রকম ফসলই হচ্ছে। চর যেহেতু কৃষিভিত্তিক এলাকা, কীভাবে এর উন্নয়ন করা যায় আমরা চেষ্টা করছি। আমরা চেষ্টা করছি চরের মানুষদের সহায়তা করতে। জীবনমান উন্নত করতে।
জেলা কৃষি দপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সৈয়দা সাফাত জাহান বলেন, আমাদের চরাঞ্চলের সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে ভুট্টা। চরের কৃষকের জন্য আলাদা কোনও প্রণোদনা না থাকলেও উপজেলাভিত্তিক যাচ্ছে। সেখান থেকে চরের কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। সব জায়গায় আমাদের পোস্টেট লোক আছেন। উপজেলা যদি দূরে হয়, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদে ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছে তাৎক্ষণিক সবরকম সেবা নিতে পারবেন।