পালপাড়ার উল্লাস পাল এবার প্রশাসন ক্যাডার

কঠিন বাস্তবতাকেও হার মানিয়ে, স্বপ্নের পিছু ছুটে একদিন সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন যারা—তাদেরই একজন শরীয়তপুরের উল্লাস পাল। জন্ম থেকেই ছিলেন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তবে মানসিক দৃঢ়তা আর অধ্যাবসায়ের কাছে হেরে গেছে সব সীমাবদ্ধতা। সমাজের করুণা নয়, নিজের মেধা আর পরিশ্রমের জোরেই তিনি এখন ৪৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত। তার জীবনগাঁথা হয়ে উঠেছে স্বপ্ন দেখার আর লড়ে জয়ের অনুপ্রেরণামূলক উপাখ্যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উল্লাস পালের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামে। মৃৎশিল্পী উত্তম কুমার পাল ও আন্না রানীর তিন সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। জন্মগতভাবে দুই হাত ও দুই পা বাঁকা হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই চলাফেরায় ছিল সীমাহীন কষ্ট। পরিবারের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে হাঁটতে শেখেন। একসময় চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতে নেওয়া হয়, অস্ত্রোপচারের পর ডান পায়ের আংশিক উন্নতি হলেও হাঁটা-চলা স্বাভাবিক হয়নি।

প্রচণ্ড মেধাবী উল্লাসের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ১৯৯৯ সালে কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্ষার দিনে স্কুলে যাওয়া ছিল কষ্টসাধ্য—তবুও বাবা উত্তম কুমার প্রতিদিন হাতে ধরে তাকে পৌঁছে দিতেন। বাম হাতে লিখতেন উল্লাস। ফুটবল খেলার ইচ্ছে থাকলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সহপাঠীদের খেলা দূর থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো।

২০১০ সালে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ প্লাস পেয়ে এসএসসি, এবং ২০১২ সালে ঢাকা নর্দান কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায়ও এ প্লাস অর্জন করেন তিনি। ইচ্ছে ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার, তবে সুযোগ পাননি। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। এরপর শুরু হয় বিসিএস যাত্রা।

৪০তম ও ৪১তম বিসিএস-এ মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। প্রথমটিতে উত্তীর্ণ হলেও পদ পাননি। ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। থেমে যাননি—লক্ষ্য ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়া। অবশেষে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন এবং নড়িয়া সরকারি কলেজে যোগদান করেন। তবুও তার হৃদয়ে ছিল প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন, আর সেটিই পূর্ণ হলো ৪৪তম বিসিএসে।

উল্লাস পাল বলেন, রেজাল্ট দেওয়ার দিন প্রশাসন ক্যাডারে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার মিলে যাওয়ার পর আনন্দে চোখে জল এসে গিয়েছিল। অনেকে ঠাট্টা করেছিল, আবার অনেকেই ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে। আমি লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়েছি। অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সরকার যেখানে দায়িত্ব দেবে, আমি সেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে চাই। প্রশাসন ক্যাডার একটি জনকল্যাণমুখী পদ। আমি সব সময় মানুষের পাশে থাকতে চাই।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্দেশে উল্লাস বলেন, যারা শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নিয়েছেন, তাদের জন্য সমাজ চাইলে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব।

উল্লাসের এই অর্জনে খুশিতে আত্মহারা তার পরিবার। মা আন্না রানী পাল বলেন, ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্টে ওকে বড় করেছি। ছেলেটা পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল। এখন ও প্রশাসন ক্যাডার—আমরা গর্বিত।

বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, আমরা ওর পড়াশোনায় কোনো কমতি রাখিনি। ওর চেষ্টা আর মনোবলই আজকের সাফল্যের মূল।

প্রতিবেশী রূপক পাল বলেন, উল্লাস দেখিয়ে দিয়েছে—প্রতিবন্ধী মানেই দুর্বল নয়। ও আমাদের গর্ব।

কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও উল্লাস ছিল দারুণ মেধাবী। ওর মতো সৎ আর দায়িত্বশীল ছাত্র খুব কম দেখি। ওর এই অর্জনে আমরা খুব খুশি।

-শরীয়তপুর প্রতিনিধি