ভোরের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আগেই রাজধানীর রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তাদের বাঁশি বেজে ওঠে। আমরা সেই শব্দে বিরক্ত হই অথবা এড়িয়ে যাই। তারা কিন্তু এতে থামেন না। বাঁশি বাজিয়ে, ভ্যানগাড়ি টেনে এগিয়ে চলেন এক গলি থেকে অন্যগলিতে। প্রতিটি বাড়ির গেইটে হাজির হন, তারপর বাসাবাড়ির নিত্যদিনের জমে থাকা ময়লা নিয়ে রাখেন ভ্যানে। ঝুপঝাপ শব্দে ময়লাগুলো জমা হতে থাকে তড়িৎ গতিতে। শহরের মানুষ জেগে ওঠার আগেই রাজপথ পরিষ্কার হয়ে যায়। এই চিত্র প্রতিদিনের- ঝড়, বৃষ্টি, রোদ কিংরা কনকনের শীতেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না।
প্রতিদিন আমাদের বাসাবাড়িতে রান্না, খাওয়া শেষে অনেক আবর্জনা জমা করে ফেলি। তারপর ঘর দূষণমুক্ত করার জন্য বাড়ির গেইটে কিংবা পাশেই কোনো ড্রামে সেই ময়লা জমা করে রাখি। গৃহস্থালির বিভিন্ন ময়লা জমা করি অভিন্ন জায়গায়- আমাদের দায়িত্ব এ টুকুতেই শেষ! পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসে এই আবর্জনাগুলো নিয়ে যান। এরপর সেগুলো ফেলে দেন নিরাপদ দূরত্বে।
যতদূর জানি ঢাকা শহরে এভাবে পরিচ্ছন্নতা প্রক্রিয়া শুরু হয় ‘কলাবাগান সোসাইটির উদ্যোগে’। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- আগে দেখা যেত, ঢাকা শহরের বিভিন্ন কোণায় বা মোড়ে মোড়ে গৃহস্থালির ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ফলে শহর দুর্গন্ধময় হয়ে থাকত। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ শুরু করার পরে দেখা গেল যত্রতত্র ময়লা পরে থাকে না। আমরা হাঁটাচলার জন্য স্বস্তিদায়ক এক পরিবেশ পাই- এটা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বিরাট অবদান।
কলাবাগান সোসাইটির নগর পরিষ্কার রাখার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কারণেই আমরা রাজধানীবাসী এই নগরসুবিধা ভোগ করছি। আমাদের শহর পরিষ্কার থাকছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা যে কত বড় প্রভাব রেখে চলেছেন আমরা আরেকটু গভীরে দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারব। তারা পরিবেশ দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের কাজটিই করে যাচ্ছেন নীরবে শত বঞ্চনা, গঞ্জনা সয়ে।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ময়লা নেওয়ার জন্য যেসব ভ্যানগাড়ি থাকে সেই ভ্যানগুলোতে একাধিক বস্তা বা প্যাকেট থাকে। আমাদের একত্রিত করে রাখা ময়লাগুলো তারা সংগ্রহ করার পর আলাদা করে ফেলেন। যেমন প্লাস্টিকের বোতল, কাচ, নারকেলের মালা, বিভিন্ন ধরনের কাগজ এবং উচ্ছিষ্ট খাবার। সব ধরনের ময়লা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাত ধরে এভাবে রিসাইকেল হয়ে যায়। অর্থাৎ পুনরায় ব্যবহার করার উপযোগী হয়।
ধরা যাক উচ্ছিষ্ট খাবারের কথা। এই খাবার পুনরায় বিক্রি হয়। মাছ বা মুরগির খাবার হিসেবে বিভিন্ন কোম্পানি সেগুলো কিনে নেয়। দেখা যায় যে, একটি পিৎজার কিছু অংশ, স্যান্ডুইচের কিছু অংশ- এগুলো তারা আলাদা করে ফেলেন। এতে রিসাইকেলটা হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষা পাচ্ছে এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিজেরাও অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছেন। এই খাত থেকে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা উপার্জন করেন। যা মোটেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আর পরিবেশ রক্ষায় তারা যে অবদান রাখছেন তার পরিমাপ করা কঠিন। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণারও সুযোগ রয়েছে।
নগরে দিনদিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানবসৃষ্ট বর্জ্য। বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রিসাইকেল সবশেষ নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। সচেনত নাগরিকরা যখন পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তখন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সেই পরিবেশ বাঁচাতে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের জব রেসপনন্সিবিলিটি বা মূল দায়িত্বের মধ্যে নগর পরিষ্কার করাটাই মূখ্য অথচ তারা সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার পরেও বর্জ্য পুনঃব্যবস্থাপনায় অবদান রেখে চলেছেন। এ সব ময়লা যদি একটি জায়গায় ডাম্পিং করা হতো তাহলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতো। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা অপচনশীল দ্রব্য-বস্তু এবং উচ্ছিষ্ট খাবারা আলাদা করে পরিবেশ রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করছেন।
এ সব কর্মীরা সব মিলিয়ে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা মজুরি পান। দুঃখের বিষয় তারা অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মী হওয়ায় চাকরির নিশ্চয়তা নেই। একেক এলাকায় একেক ঠিকাদার তাদের ডেকে নেন। মূলতা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা একজন ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন। কাজটি কিন্তু সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশন যদি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের চাকরিতে স্থায়ী করে নেয় তাহলে তারা এক অনিশ্চিত জীবন যাপন থেকে মুক্ত হতে পারেন। এবং পরিবেশ ও নগর রক্ষায় নিজেদের আরো ভালোভাবে নিয়োজিত করতে পারবেন।
রাজধানীর মোট জনসংখ্যার সৃষ্ট আবর্জনা তারা পরিষ্কার করে নাগরিক স্বাস্থ্য রক্ষায় অবদান রাখছেন। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসবে তাদের কাজের চাপ আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়। তাদের কর্মপ্রচেষ্টা তবু থেমে থাকে না। বৈরী আবহাওয়াতেও রাজধানীর রাস্তায় দেখা মেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। মে দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক, আমরা যেন তাদের কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করার চেষ্টা করি। তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকি; আমাদের শিশুদের তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাই।
সিটি করপোরেশনের প্রতি বিশেষ আহ্বান- পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের চাকরি স্থায়ী করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। এবং তাদের ন্যায্য মজুরি প্রদান করুন।
লেখক: প্রকাশক, রাইজিংবিডি ডটকম