যে সমাজের মানুষ শৈশবকে যত বেশী উপভোগ করতে পারে সে সমাজের মানুষের আচরণে তত বেশী ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এস্তোনিয়া এবং ফিনল্যান্ডের শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইল্ড সাইকোলোজি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ গবেষক দিয়ে শিশুর মনোজগৎ নিয়ে গবেষণা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। সেজন্য তারা স্কুলের শিক্ষাকে কীভাবে চাপমুক্ত রাখা যায়, কীভাবে আনন্দদায়ক করা যায় সে বিষয়ে খুবই সতর্ক। জানা যায়, এস্তোনিয়া এবং ফিনল্যান্ডের স্কুল শিক্ষায় আনুষ্ঠানিক কোন পরীক্ষা পদ্ধতি নেই। শ্রেণী উপযোগী একটি বিশেষ মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে স্বতন্ত্র গ্রেড তৈরী করে শিক্ষার্থীদেরকে এক গ্রেড থেকে আরেক গ্রেডে আপ-গ্রেড করা হয়। বছরে তিনটি সেমিস্টারের মাধ্যমে একটি গ্রেড সম্পূর্ণ করা হয়। রেজাল্ট কার্ড শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর অভিভাবককে দেখানো হয়। শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যকে তুলনা করবে বিধায় এক শিক্ষার্থীর গ্রেড আরেক শিক্ষার্থীকে দেখানো হয় না। কোন শিক্ষার্থী কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দূর্বল থাকলে শ্রেণীকক্ষে তার বন্ধুদের সামনে কিছু না বলে অভিভাবককে ডেকে শিশুর দূর্বলতার জায়গাটিতে মনোযোগ দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া তেমন কোন বাড়ির কাজ দেয়া হয় না। শিক্ষার্থীদেরকে ব্যাগ ভর্তি বই নিয়ে স্কুলে যেতে হয় না। বই স্কুলেই থাকে।
আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা না থাকার ব্যাখ্যা উদাহরণ হিসেবে জানা যায় যে, একটি শ্রেণীতে যদি পঞ্চাশজন শিক্ষার্থী থাকে তাহলে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে যে কোন একজন প্রথম স্থান অধিকার করে, অন্যরা ক্রমান্বয়ে পিছনে থাকে। কম বয়সে শিক্ষার্থীরা এ বিষয়টি বুঝতে না পারলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটা সময়ে যখন বুঝতে শুরু করে তখন তারা পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে নিজেদেরকে তুলনা করে। যে শিক্ষার্থীটি প্রথম স্থান অধিকার করে তার মধ্যে সুপারিউরিটি কমপ্লেক্সিটি সৃষ্টি হতে পারে। বিপরীতক্রমে, পিছনের দিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে ইনফেরিউরিটি কমপ্লেক্সিটি। আবার, প্রথম দিকের শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ একে অন্যকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পারে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা পদ্ধতি একেকজন শিক্ষার্থীকে একেকভাবে প্রভাবিত করে। এ অভিজ্ঞতা তাদের ভবিষ্যৎ আচরণকেও নানাভাবে প্রভাবিত করে। ফলে, শিক্ষার মূল জাতীয় উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। কিন্তু শিক্ষার জাতীয় উদ্দেশ্য হলো সুনাগরিক গড়ে তোলা, শুধুমাত্র রেজাল্ট নির্ভর মেধা যাচাই করা নয়।
এ দুই দেশে স্কুল জীবনের শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদেরকে দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো শেখানো হয়- যেমনঃ কখন ঘুমাতে যেতে হয়, কখন ঘুম থেকে উঠতে হয়, রাস্তা পারাপারের সময় কীভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হয়, বাড়িঘর, স্কুল কিংবা চলার পথে রাস্তাঘাট কীভাবে পরিষ্কার রাখতে হয়, ময়লা ফেলার থ্রাশ কেনগুলো কোথায় থাকে ইত্যাদি। পাশাপাশি পর্যবেক্ষণ করা হয় শিক্ষার্থীরা কীভাবে একে অন্যের সাথে বন্ধুতা স্থাপন করে। কোন শিক্ষার্থী বন্ধুদের সাথে মিশতে না চাইলে তার প্রতি আলাদা নজর দেয়া হয়। শিক্ষকরা বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের সাথে নাচ, গান ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করে যাতে তারা জড়তাহীনভাবে নিজেকে সবার সামনে প্রকাশ করতে পারে। একইসাথে শিক্ষার্থীদের শ্রেণী উপযোগী মানসিক বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
ইতিবাচক মানসিক বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদেরকে সব সময় উপলদ্ধি করায় যে, তারা যে জীবনটা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে তা খুবই মূল্যবান। জীবনটাকে যত বেশী উপভোগ্য করে গড়ে তোলা যাবে তত বেশী জীবন স্বার্থক হয়ে উঠবে। এটা তাদের অনুভূতিতে আনতে হবে, এটা তাদেরকে শিখিয়ে মূখস্ত করানোর বিষয় নয়। শিক্ষার্থীদের জীবনকে উপভোগ্য করে তোলার জন্য তারা লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুলে বিভিন্ন রকম নাচ, গান, শরীর চর্চা, খেলাধুলা এবং বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায় যাতে শিশুরা স্কুলের সময়টাতে আনন্দ পায়। মানবিকতা শেখানোর জন্য শিক্ষার্থীদেরকে মাঝে মাঝে অসহায়, দরিদ্র এবং এতিমদেরকে দেখাতে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে আর্থিক সাহায্য দেয়ার জন্য উৎসাহিত করে থাকে। প্রকৃতিকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় তা শেখানোর জন্য শিক্ষার্থীদেরকে দিয়ে স্কুলে গাছ লাগানো হয় এবং সারা বছর ধরে নিয়মিতভাবে যার যার গাছকে পরিচর্যা করায়। একইভাবে, প্রাণিজগতকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় তা শেখানোর জন্য কার বাসায় কি পোষা প্রাণি আছে এবং সেগুলোকে কীভাবে সেবা করবে তা শেখানো হয়।
কিছু জরুরী বিষয় ছাড়া স্কুলে শিক্ষার্থীদের মূখস্ত করানোর তেমন কোন চর্চা নেই। তাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা সৃষ্টি করা। সেটা করার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে শেখানোর চেষ্টা করা হয়। যেমনঃ প্রাণিজগৎ সম্পর্কে পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীদেরকে চিড়িয়াখানায় এবং উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে পড়ানোর সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে, সভ্যতা সম্পর্কে পড়ানোর সময় ইন্টারনেটে দেখানো ছাড়াও বিভিন্ন মিউজিয়ামে নিয়ে দেখানো হয় কোন প্রযুক্তি বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানে কোন পর্যায়ে এসেছে। এমনিভাবে যতটা সম্ভব বইয়ের জগতের সাথে বাস্তব জগতকে মিলানো হয় যাতে শিক্ষার্থীরা পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সব কিছু বিশ্লেষণ করতে পারে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য প্রতিদিনের পড়া স্ব-স্ব শ্রেণী শিক্ষক ইমেইলের মাধ্যমে অভিভাবকদেরকে জানিয়ে দেন। এছাড়া, অভিভাবকদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। তারা কোথাও একটি ভালো বই পেলে সেটি স্কুলে পৌঁছে দেয় যাতে সবাই উপকৃত হতে পারে। এছাড়া স্কুলের শিক্ষাকে আরো কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা তারা খোঁজখবর নিয়ে থাকে। কয়েক মাস পরপর শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মিটিং অনুষ্ঠিত হয় যেখানে অভিভাবকদের নিকট থেকে পরাপর্শ চাওয়া হয়।
বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষায় প্রথম গ্রেড থেকেই আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এরই সাথে ২০০৯ সাল থেকে যুক্ত হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং ২০১০ সাল থেকে শুরু হয় জেএসসি/জেডিসি নামক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। ফলে, শিক্ষার্থীদের সোনালী শৈশব পরীক্ষার জালে আটকা পড়ে যায়। এ পরীক্ষা পদ্ধতির নেতিবাচক দিক নিয়ে দীর্ঘদিন সচেতন সমাজ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন শিক্ষায় গলদ আছে বলেই আমাদের সমাজে বর্বতা বাড়ছে (Jagonews24.com এপ্রিল ২৩, ২০১৯)। এরই প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সমাপনী পরীক্ষাসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা তুলে দেয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন (দৈনিক জনকন্ঠ, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৯)। নির্দেশটি বাস্তবায়িত হলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা শৈশবকে উপভোগ করার সুযোগ পাবে। তবে, এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যমান অবকাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে গঠিত ম্যানেজিং কমিটির অবসান ঘটিয়ে শিক্ষকদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এস্তোনিয়া এবং ফিনল্যান্ডে প্যাডাগজিক্যাল (শিক্ষন-শিখন) প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ স্কুলে শিক্ষকতা করতে পারে না। আমাদেরকেও প্যাডাগজিক্যাল প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং কোটামুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। একই সাথে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ এ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে (এডুকেশন বাংলা, মে ০১, ২০১৮)। সর্বোপরি, বিশেষজ্ঞ গবেষক দিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখতে হবে আমাদের দেশে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা তুলে দিয়ে সকল শিক্ষার্থীকে সমানভাবে যত্ন নেয়া সম্ভব হবে কিনা। তবে, সীমাবদ্ধতাসমূহ কাটিয়ে এ পদ্ধতি চালু করা গেলে আমাদের দেশ নিঃসন্দেহে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যাবে।
মাঈন উদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক,
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমানে, পিএইচডি গবেষক,
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, তালিন ইউনিভার্সিটি, এস্তোনিয়া।
Mujjnubd11@gmail.com